Wednesday, May 9, 2018

অনন্ত জীবন - অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ

>> অনন্ত জীবন <<
প্রভাত সংগীত
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ
জনমেছি দুদিনের তরে,
যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে
গান গাই আনন্দের ভরে।
এ আমার গানগুলি দুদণ্ডের গান,
র'বে না র'বে না চিরদিন,
পুরব আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস,
পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।
তা ব’লে নয়নে কেন ওঠে অশ্রুজল—
কেন তোর দুঃখের নিশ্বাস,
গীত গান বন্ধ ক’রে রয়েছিস বসে
কেন ওরে হৃদয় হতাশ।
আনন্দের প্রাণ তোর, আনন্দের গান,
সাঙ্গ তাহা করিসনে আজ—
যখন যা মনে হবে উঠিবি গাহিয়া
এই শুধু—এই তোর কাজ।
একবার ভেবে দেখ্—ভেবে দেখ্ মন
পৃথিবীতে পাখি কেন গায়;
জাগিয়া দেখে সে চেয়ে প্রভাত কিরণ
আকাশেতে উথলিয়া যায়;
অমনি নয়নে ফোটে আনন্দের আলো,
কণ্ঠ তুলি মনের উচ্ছ্বাসে
সংগীতনির্ঝরস্রোতে ঢেলে দেয় প্রাণ—
ঢেলে দেয় অনন্ত আকাশে।
কনক মেঘেতে যেন খেলাবার তরে
গানগুলি ছুটে বাহু তুলি
প্রিয়তমা পাশে বসি—বুকের কাছেতে
ঘেঁসে আসে ছোটো ছানাগুলি।
কাল গান ফুরাইবে, তা ব'লে গাবে না কেন,
আজ যবে হয়েছে প্রভাত।
আজ যবে জ্বলিছে শিশির
আজ যবে কুসুম কাননে
বহিয়াছে বিমল সমীর।
আজ যবে ফুটেছে কুসুম,
নলিনীর ভাঙিয়াছে ঘুম,
পল্লবের শ্যামল-হিল্লোল,
তটিনীতে উঠেছে কল্লোল,
নয়নেতে মোহ লাগিয়াছে,
পরানেতে প্রেম জাগিয়াছে।
তোরা ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ,
জগতের আনন্দ যে তোরা,
জগতের বিষাদ-পাসরা।
পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দ-লহরী
তোরা তার একেকটি ঢেউ,
কখন্ উঠিলি আর কখন্ মিলালি
জানিতেও পারিল না কেউ।
কত শত উঠিতেছে, যেতেছে টুটিয়া
কে বলে রাখিবে তাহা মনে;
তা ব’লে কি সাধ যায় লুকাইতে প্রাণ
সূর্যহীন আঁধার মরণে।
যা হবে তা হবে মোর, কিসের ভাবনা,
রাখি শুধু মুহূর্তের আশ,
আনন্দ সাগরে সেই হইয়া একটি ঢেউ
মূহূর্তেই পাইব বিনাশ।
প্রতিদিন কত শত ফুটে ওঠে ফুল,
প্রতিদিন ঝরে পড়ে যায়,
ফুল-বাস মুহূর্তে ফুরায়।
প্রতিদিন কত শত পাখি গান গায়,
গান তার শূন্যেতে মিশায়।
ভেসে যায় শত ফুল, ভেসে যায় বাস,
ভেসে যায় শত শত গান—
তারি সাথে, তারি মাঝে দেহ এলাইয়া
ভেসে যাবি তুই মোর প্রাণ।
তুই ফুরাইয়া গেলে গান ফুরাইবে,
কত সহে সংগীতের প্রাণে।
আবার নূতন কবি এই উপবনে,
আসিয়া বসিবে এই খানে।
তোরি মতো রহিবে সে পুরবে চাহিয়া,
দেখিবে সে উষার বিকাশ,
অমনি আপনা হতে হৃদয় উথলি
উঠিবেক গানের উচ্ছ্বাস।
তুই যাবি, সেও যাবে, একেকটি পাখি,
একেকটি সংগীতের কণা,
তা বলিয়া—যতদিন রবি শশী আছে
জগতের গান ফুরাবে না;
তবে আর কিসের ভাবনা।

গারে গান প্রভাত-কিরণে।
যারা তোর প্রাণসখা, যারা তোর প্রিয়তম
ওই তারা কাছে ব’সে শোনে।
নাই তোর নাইরে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা,
ভেসে আসে, সাগরে মিশায়,
জানো না কোথায় তারা যায়!
একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর
রচিছে বিশাল মহাদেশ,
না জানি কবে তা হবে শেষ।
মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,
জানো না তো কোথায় তা যায়
আকাশের সাগর সীমায়।
আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে
গীতরাজ্য হতেছে সৃজন,
যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে
সেইখানে করিছে গমন।
আকাশ পূরিয়া যাবে শেষ,
উঠিবে গানের মহাদেশ।
করিব গানের মাঝে বাস,
লইব রে গানের নিশ্বাস,
ঘুমাইব গানের মাঝারে,
বহে যাবে গানের বাতাস।
নাই তোর নাইরে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
প্রাণপণে ভালবাসা ক'রে সমর্পণ
ফিরে তাহা পেলিনে না হয়—
বৃথা নহে নিরাশ-প্রণয়।
নিমেষের মোহে জন্মে যে প্রেম উচ্ছ্বাস
নিমেষেই করে পলায়ন,
সেও কভু জানে না মরণ।
জগতের তলে তলে তিলে তিলে পলে পলে
প্রেমরাজ্য হতেছে সৃজন,
সেথায় সে করিছে গমন।
কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল
দুটি ভাই গলাগলি করি;
দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল
দুটি সখা হাতে হাতে ধরি,—
দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে
ঘুমায়ে করিছে স্তন পান,
ঘুমন্ত মুখের পরে বরষিছে স্নেহ-ধারা
স্নেহমাথা নত দুনয়ান;
দেখেছিনু রাজ পথে চলেছে বালক এক
বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি—
কত কী যে দেখেছিনু হয়তো সে সব ছবি
আজ আমি গিয়েছি পাসরি।
তা ব'লে নাহি কি তাহা মনে।
ছবিগুলি মেশেনি জীবনে?
স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি
রচিতেছে জীবন আমার—
কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে
চিনিতে পারিনে তাহা অার।
হয়তো অনেক দিন দেখেছিনু ছবি এক
দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে—
তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি
সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে।
হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু পাখি এক
আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি,
সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি
প্রাণ মন উঠিছে উখুলি।
সকলি মিশিছে আসি হেথা,
জীবনে কিছু না যায় ফেলা,
এই যে যা কিছু চেয়ে দেখি
এ নহে কেবলি ছেলেখেলা ।
এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে
নিস্তব্ধ তাহার জল রাশি,
চারিদিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম
জীবনের স্রোত মিশে আসি।
সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা
কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,
জগতের যত হাসি, যত গান, যত প্রাণ
ভেসে অাসে সেই স্রোতোভরে,
মেশে আসি সেই সিন্ধু পরে।
পৃথ্বি হতে মহাশ্রোত ছুটিতেছে অবিরাম
সেই মহাসাগর-উদ্দেশে;
আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি
অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে
সাগরে পড়িব অবশেষে।
জগতের মাঝখানে, সেই সাগরের তলে
রচিত হতেছে পলে পলে,
অনন্ত-জীবন মহাদেশ;
কে জানে হবে কি তাহা শেষ।
তাই বলি প্রাণ ওরে—মরণের ভয় করে
কেনরে আছিস ম্রিয়মাণ
সমাপ্ত করিয়া গীত গান।
গান গা' পাখির মতো, ফোট্রে ফুলের প্রায়,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি—
তুই যাবি, গান যাবে, এক সাথে ভেসে যাবে
তুই, আর তোর গানগুলি।
মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্ত সাগর তলে,
এক সাথে শুয়ে র'বি প্রাণ,
তুই, আর তোর এই গান।

Monday, April 2, 2018

আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে

আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,
নীল আকাশের ঘুম ছুটালে॥
আমার মনের ভাব্নাগুলি বাহির হল পাখা
তুলি,
ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে॥
শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।
তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে কচি ধানের
সবুজ ক্ষেতে,
বনের প্রাণে মর্মরানির ঢেউ উঠালে॥
-
রাগ: রামকেলী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ফাল্গুন, ১৩৩৩
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1927
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

Wednesday, February 28, 2018

মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে

মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।
মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে॥
কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরন-ছটাতে।
হেরো পুরানো প্রাচীন ধরণী   হয়েছে শ্যামলবরনী,
যেন যৌবন-প্রবাহ ছুটিছে কালের শাসন টুটাতে;
পুরানো বিরহ হানিছে, নবীন মিলন আনিছে,
নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে॥
-
রাগ: বাহার
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১২৯৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1888
রচনাস্থান: কলকাতা, দার্জিলিং
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী

ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি

ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি,
শুনতে কি পাস দূরের থেকে পারের বাঁশি উঠছে বাজি॥
তরী কি তোর দিনের শেষে ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।
সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি॥
যেন আমার লাগে মনে মন্দ-মধুর এই পবনে
সিন্ধুপারের হাসিটি কার আঁধার বেয়ে আসছে আজি।
আসার বেলায় কুসুমগুলি কিছু এনেছিলেম তুলি,
যেগুলি তার নবীন আছে এই বেলা নে সাজিয়ে সাজি॥
-
রাগ: শ্রী
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৭ শ্রাবণ, ১৩১৭
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
রচনাস্থান: বোলপুর
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

Thursday, February 1, 2018

চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে

চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে
নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে।
জীবণ মরণ সুখ দুখ দিয়ে
বক্ষে ধরিব জড়ায়ে॥
স্খলিত শিথিল কামনার ভার
বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর,
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ো হার,
ফেলো না আমারে ছড়ায়ে॥
বিকায়ে বিকায়ে দীন আপনারে
পারি না ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে,
তোমার করিয়া নিয়ো গো আমারে
বরণের মালা পরায়ে॥

হৃদয় বসন্তবনে যে মাধুরী বিকাশিল

হৃদয় বসন্তবনে যে মাধুরী বিকাশিল
সেই প্রেম সেই মালিকায় রূপ নিল,
রূপ নিল।
এই ফুলহারে প্রেয়সী তোমারে
বরণ করি
অক্ষয় মধুর সুধাময়
হোক মিলনবিভাবরী।
প্রেয়সী তোমায় প্রাণবেদিকায়
প্রেমের পূজায় বরণ করি॥
কহো কহো মোরে প্রিয়ে,
আমারে করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে।
অয়ি বিদেশিনী,
তোমার কাছে আমি কত ঋণে ঋণী।

Saturday, December 23, 2017

আমি যখন ছিলেম অন্ধ

আমি যখন ছিলেম অন্ধ,
সুখের খেলায় বেলা গেছে পাই নি তো আনন্দ।
খেলা ঘরের দেয়াল গেঁথে
খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
ভিত ভেঙে যেই আসলে ঘরে
ঘুচল আমার বন্ধ,
সুখের খেলা আর রোচে না
পেয়েছি আনন্দ॥
ভীষণ আমার, রুদ্র আমার,
নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার,
উগ্র ব্যথায় নূতন ক'রে
বাঁধলে আমার ছন্দ।
যেদিন তুমি অগ্নিবেশে
সব-কিছু মোর নিলে এসে,
সেদিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব,
দুঃখ সুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥ 
-
রাগ: কীর্তন
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): শ্রাবণ, ১৩৩৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1932
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার