Wednesday, January 27, 2016

শেষের মধ্যে অশেষ আছে

শেষের মধ্যে অশেষ আছে,
এই কথাটি  মনে
আজকে আমার গানের শেষে
জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।
সুর গিয়েছে থেমে তবু
থামতে যেন চায় না কভু,
নীরবতায় বাজছে বীণা
বিনা প্রয়োজনে।
তারে যখন আঘাত লাগে,
বাজে যখন সুরে--
সবার চেয়ে বড়ো যে গান
সে রয় বহুদূরে।
সকল আলাপ গেলে থেমে
শান্ত বীণায় আসে নেমে,
সন্ধ্যা যেমন দিনের শেষে
বাজে গভীর স্বনে।
-
কলিকাতা, ২৬ শ্রাবণ, ১৩১৭

Tuesday, January 26, 2016

Kholo Kholo Dar Rakhio Na Ar - খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।

খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও
এসো দুই বাহু বাড়ায়ে॥
কাজ হয়ে গেছে সারা, উঠেছে সন্ধ্যাতারা,
আলোকের খেয়া হয়ে গেল দেয়া
অস্তসাগর পারায়ে॥
ভরি লয়ে ঝারি এনেছি তো বারি
সেজেছি তো শুচি দুকূলে,
বেঁধেছি তো চুল, তুলেছি তো ফুল
গেঁথেছি তো মালা মুকুলে।
ধেনু এল গোঠে ফিরে,
পাখিরা এসেছে নীড়ে,
পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত
আঁধারে গিয়েছে হারায়ে॥
-
রাগ: ইমনকল্যাণ
তাল: কাহারবা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1317
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1910
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

Sunday, January 24, 2016

জাগিবার চেষ্টা - মা কেহ কি আছ মোর, কাছে এসো তবে,

জাগিবার চেষ্টা
- কড়ি ও কোমল,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
মা কেহ কি আছ মোর, কাছে এসো তবে,
পাশে বসে স্নেহ ক'রে জাগাও আমায়।
স্বপ্নের সমাধিমাঝে বাঁচিয়া কী হবে,
যুঝিতেছি জাগিবারে--আঁখি রুদ্ধ হায়।
ডেকো না ডেকো না মোরে ক্ষুদ্রতার মাঝে,
স্নেহময় আলস্যেতে রেখো না বাঁধিয়া,
আশীর্বাদ করে মোরে পাঠাও গো কাজে--
পিছনে ডেকো না আর কাতরে কাঁদিয়া।
মোর বলে কাহারেও দেব না কি বল,
মোর প্রাণে পাবে না কি কেহ নব প্রাণ।
করুণা কি শুধু ফেলে নয়নের জল,
প্রেম কি ঘরের কোণে গাহে শুধু গান?
তবেই ঘুচিবে মোর জীবনের লাজ
যদি মা করিতে পারি কারো কোনো কাজ॥

Saturday, January 23, 2016

শেষ কথা - মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে,

শেষ কথা
- কড়ি ও কোমল,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে,
সে কথা হইলে বলা সব বলা হয়।
কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে,
তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয়।
শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে,
পাখির মতন ধায় চরাচরময়।
শত গান ম'রে গিয়ে, নূতন জীবনে
একটি কথায় চাহে হইতে বিলয়।
সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি,
আর বাজাব না বীণা চিরদিন-তরে।
সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি,
মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে।
সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে,
আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে।

প্রাণ - মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

প্রান
- কড়ি ও কোমল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি- অশ্রু-ময়,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।

প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে।

প্রভাত-আলোর ধারায় আমার
নয়ন ভেসেছে।
এই তোমারি প্রেমের বাণী
প্রাণে এসেছে।
তোমারি ওই মুখ নুয়েছে,
মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে
তোমারি চরণ॥

Friday, January 22, 2016

Tumi Ektu Kebol boshte Deyo Kache - তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে,

তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু ক্ষণেক তরে।
আজি হাতে আমার যা কিছু কাজ আছে
আমি সাঙ্গ করব পরে।
না চাহিলে তোমার মুখপানে
হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে,
কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াই যত
ফিরি কূলহারা সাগরে॥
বসন্ত আজ উচ্ছ্বাসে নিশ্বাসে
এল আমার বাতায়নে।
অলস ভ্রমর গুঞ্জরিয়া আসে
ফেরে কুঞ্জের প্রাঙ্গণে।
আজকে শুধু একান্তে আসীন
চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিন,
আজকে জীবন-সমর্পণের গান
গাব নীরব অবসরে॥
-
রাগ: ভৈরবী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৯ চৈত্র, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1912
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভীমরাও শাস্ত্রী

মরীচিকা - এসো, ছেড়ে এসো, সখী, কুসুমশয়ন।

মরীচিকা
- কড়ি ও কোমল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
এসো, ছেড়ে এসো, সখী, কুসুমশয়ন।
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন।
দেখো ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা,
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আঁধার নিদ্রা বিমল অনলে।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে,
সুখ দুঃখ লয়ে সবে গাঁথিছে আলয়--
হাসি কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয়।
সুখরৌদ্রমরীচিকা নহে বাসস্থান,
মিলায় মিলায় বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ।

Thursday, January 21, 2016

দান - হে উষা তরুণী,

দান
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
হে উষা তরুণী,
নিশীথের সিন্ধুতীরে নিঃশব্দের মন্ত্রস্বর শুনি
যেমনি উঠিলে জেগে, দেখিলে তোমার শয্যাশেষে
তোমারি উদ্দেশে
রেখেছে ফুলের ডালি
শিশিরে প্রক্ষালি
কোন্ মহা-অন্ধকারে কে প্রেমিক প্রচ্ছন্ন সুন্দর।
তোমারে দিয়েছে বর
তোমার অজ্ঞাতে
সুপ্তিঢাকা রাতে,
তব শুভ্র আলোকেরে করিয়া স্মরণ
আগে হতে করেছে বরণ।
নিজেরে আড়াল করি
বর্ণে গন্ধে ভরি
প্রেমের দিয়েছে পরিচয়
ফুলেরে করিয়া বাণীময়।
মৌনী তুমি, মুগ্ধ তুমি, স্তব্ধ তুমি,
চক্ষু ছলোছলো--
কথা কও, বলো কিছু বলো,
তোমার পাখির গানে
পাঠাও সে-অলক্ষ্যের পানে
প্রতিভাষণের বাণী,
বলো তারে-- হে অজানা,
জানি আমি জানি,
তুমি ধন্য, তুমি প্রিয়তম,
নিমেষে নিমেষে তুমি চিরন্তন মম।

আরশি - তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে হাসিমুখ মেজে,

আরশি
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে
হাসিমুখ মেজে,
সেইক্ষণে অবিকল সেই ছায়াটিরে
ফিরে দিল সে যে।
রাখিল না কিছু আর,
স্ফটিক সে নির্বিকার
আকাশের মতো--
সেথা আসে শশী রবি,
যায় চলে, তার ছবি
কোথা হয় গত।
একদিন শুধু মোরে ছায়া দিয়ে, শেষে
সমাপিলে খেলা
আত্মভোলা বসন্তের উন্মত্ত নিমেষে
শুক্ল সন্ধ্যাবেলা।
সে ছায়া খেলারই ছলে
নিয়েছিনু হিয়াতলে
হেলাভরে হেসে,
ভেবেছিনু চুপে চুপে
ফিরে দিব ছায়ারূপে
তোমারি উদ্দেশে।
সে ছায়া তো ফিরিল না, সে আমার প্রাণে
হল প্রাণবান।
দেখি, ধরা পড়ে গেল কবে মোর গানে
তোমার সে দান।
যদিবা দেখিতে তারে
পারিতে না চিনিবারে
অয়ি এলোকেশী--
আমার পরান পেয়ে
সে আজি তোমারো চেয়ে
বহুগুণে বেশি।
কেমনে জানিবে তুমি তারে সুর দিয়ে
দিয়েছি মহিমা।
প্রেমের অমৃতস্নানে সে যে, অয়ি প্রিয়ে,
হারায়েছে সীমা।
তোমার খেয়াল ত্যেজে
পূজার গৌরবে সে যে
পেয়েছে গৌরব।
মর্তের স্বপন ভুলে
অমরাবতীর ফুলে
লভিল সৌরভ।
-
৯ মাঘ, ১৩৩৮

বধূ - যে-চিরবধূর বাস তরুণীর প্রাণে

বধূ
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-

যে-চিরবধূর বাস তরুণীর প্রাণে
সেই ভীরু চেয়ে আছে ভবিষ্যৎ-পানে
অনাগত অনিশ্চিত ভাগ্যবিধাতার
সাজায়ে পূজার ডালি।
কল্পমূর্তি তার
প্রতিষ্ঠা করেছে মনে।
যাহারে দেখে নি
একান্তে স্মরিয়া তারে সুনিপুণ বেণী
কুসুমে খচিত করি তুলে।
সযতনে
পরে নীলাম্বরী শাড়ি।
নিভৃতে দর্পণে
দেখে আপনার মুখ।
শুধায় সভয়ে--
হব কি মনের মতো, পাব কি হৃদয়ে
সৌভাগ্য-আসন।
                    কোন্ দূরের কল্যাণে
সঁপিছে করুণ ভক্তি দেবতার ধ্যানে।
আগন্তুক অজানার পথ-পানে থেমে
উদ্দেশে নিজের সঁপে আগামিক প্রেমে।
-
১৪ মাঘ, ১৩৩৮

পুষ্প -পুষ্প ছিল বৃক্ষশাখে, হে নারী, তোমার অপেক্ষায় পল্লবচ্ছায়ায়।

পুষ্প
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
পুষ্প ছিল বৃক্ষশাখে, হে নারী,
তোমার অপেক্ষায় পল্লবচ্ছায়ায়।
তোমার নিশ্বাস তারে লেগে
অন্তরে সে উঠিয়াছে জেগে,
মুখে তব কী দেখিতে পায়।
সে কহিছে-- "বহু পূর্বে তুমি
আমি কবে একসাথে
আদিম প্রভাতে
প্রথম আলোকে জেগে উঠি
এক ছন্দে বাঁধা রাখী দুটি
দুজনে পরিনু হাতে হাতে।
"আধো আলো-অন্ধকারে উড়ে এনু
মোরা পাশে পাশে
প্রাণের বাতাসে।
একদিন কবে কোন্ মোহে
দুই পথে চলে গেনু দোঁহে
আমাদের মাটির আবাসে।
"বারে বারে বনে বনে জন্ম লই নব
নব বেশে নব নব দেশে।
যুগে যুগে রূপে রূপান্তরে
ফিরিনু সে কী সন্ধান-তরে
সৃজনের নিগূঢ় উদ্দেশে।
"অবশেষে দেখিলাম কত জন্ম-পরে
নাহি জানি
ওই মুখখানি।
বুঝিলাম আমি আজও আছি
প্রথমের সেই কাছাকাছি,
তুমি পেলে চরমের বাণী।
"তোমার আমার দেহে আদিছন্দ
আছে অনাবিল
আমাদের মিল।
তোমার আমার মর্মতলে
একটি সে মূল সুর চলে,
প্রবাহ তাহার অন্তঃশীল।
"কী যে বলে সেই সুর,
কোন্ দিকে তাহার প্রত্যাশা,
জানি নাই ভাষা।
আজ, সখী, বুঝিলাম আমি
সুন্দর আমাতে আছে থামি--
তোমাতে সে হল ভালোবাসা।'
-
১১ মাঘ, ১৩৩৮

আশীর্বাদ - পঞ্চাশ বছরের কিশোর --

আশীর্বাদ
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
পঞ্চাশ বছরের কিশোর গুণী নন্দলাল বসুর প্রতি
সত্তর বছরের প্রবীণ যুবা রবীন্দ্রনাথের
আশীর্ভাষণ
    নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,
জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।
অঞ্জন সে কী মধুরাতে
লাগালো কে যে নয়নপাতে,
সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা।
এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,
রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি।
যে মায়াবিনী আলিম্পনা সবুজে নীলে লালে
কখনো আঁকে কখনো মোছে অসীম দেশে কালে,
মলিন মেঘে সন্ধ্যাকাশে
রঙিন উপহাসি যে হাসে
রঙজাগানো সোনার কাঠি সেই ছোঁয়ালো ভালে।
বিশ্ব সদা তোমার কাছে ইশারা করে কত,
তুমিও তারে ইশারা দাও আপন মনোমত।
বিধির সাথে কেমন ছলে
নীরবে তব আলাপ চলে,
সৃষ্টি বুঝি এমনিতরো ইশারা অবিরত।
ছবির 'পরে পেয়েছ তুমি রবির বরাভয়,
ধূপছায়ার চপল মায়া করেছ তুমি জয়।
তব আঁকন-পটের 'পরে
জানি গো চিরদিনের তরে
নটরাজের জটার রেখা জড়িত হয়ে রয়।
চিরবালক ভুবনছবি আঁকিয়া খেলা করে,
তাহারি তুমি সমবয়সী মাটির খেলাঘরে।
তোমার সেই তরুণতাকে
বয়স দিয়ে কভু কি ঢাকে,
অসীম-পানে ভাসাও প্রাণ খেলার ভেলা-'পরে।
তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে,
নববালক জন্ম নেবে নূতন আলোকেতে।
ভাবনা তার ভাষায় ডোবা--
মুক্ত চোখে বিশ্বশোভা
দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে।
-
শান্তিনিকেতন , রাসপূর্ণিমা,
৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৮

গোয়ালিনী - হাটেতে চল পথের বাঁকে বাঁকে,

গোয়ালিনী
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
হাটেতে চল পথের বাঁকে বাঁকে,
হে গোয়ালিনী, শিশুরে নিয়ে কাঁখে।
হাটের সাথে ঘরের সাথে
বেঁধেছ ডোর আপন হাতে
পরুষ কলকোলাহলের ফাঁকে।
হাটের পথে জানি না কোন্ ভুলে
কৃষ্ণকলি উঠিছে ভরি ফুলে।
কেনাবেচার বাহনগুলা
যতই কেন উড়াক ধুলা
তোমারি মিল সে ওই তরুমূলে।
শালিখপাখি আহারকণা-আশে
মাঠের 'পরে চরিছে ঘাসে ঘাসে।
আকাশ হতে প্রভাতরবি
দেখিছে সেই প্রাণের ছবি,
তোমারে আর তাহারে দেখে হাসে।
মায়েতে আর শিশুতে দোঁহে মিলে
ভিড়ের মাঝে চলেছ নিরিবিলে।
দুধের ভাঁড়ে মায়ের প্রাণ
মাধুরী তার করিল দান,
লোভের ভালে স্নেহের ছোঁওয়া দিলে।

কুমার - কুমার, তোমার প্রতীক্ষা করে নারী,

কুমার
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
কুমার, তোমার প্রতীক্ষা করে নারী,
অভিষেক-তরে এনেছে তীর্থবারি।
সাজাবে অঙ্গ উজ্জ্বল বরবেশে,
জয়মাল্য-যে পরাবে তোমার কেশে,
বরণ করিবে তোমারে সে-উদ্দেশে
দাঁড়ায়েছে সারি সারি।
দৈত্যের হাতে স্বর্গের পরাভবে
বারে বারে, বীর, জাগ ভয়ার্ত ভবে।
ভাই ব'লে তাই নারী করে আহ্বান,
তোমারে রমণী পেতে চাহে সন্তান,
প্রিয় ব'লে গলে করিবে মাল্য দান
আনন্দে গৌরবে।
হেরো, জাগে সে যে রাতের প্রহর গণি,
তোমার বিজয়শঙ্খ উঠুক ধ্বনি।
গর্জিত তব তর্জনধিক্কারে
লজ্জিত করো কুৎসিত ভীরুতারে,
মন্দ্রিত হোক বন্দীশালার দ্বারে
মুক্তির জাগরণী।
তুমি এসে যদি পাশে নাহি দাও স্থান,
হে কিশোর, তাহে নারীর অসম্মান।
তব কল্যাণে কুঙ্কুম তার ভালে,
তব প্রাঙ্গণে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে,
তব বন্দনে সাজায় পূজার থালে
প্রাণের শ্রেষ্ঠ দান।
তুমি নাই, মিছে বসন্ত আসে বনে
বিরহবিকল চঞ্চল সমীরণে।
দুর্বল মোহ কোন আয়োজন করে
যেথা অরাজক হিয়া লজ্জায় মরে--
ওই ডাকে, রাজা, এসো এ শূন্য ঘরে
হৃদয়সিংহাসনে।
চেয়ে আছে নারী, প্রদীপ হয়েছে জ্বালা--
বিফল কোরো না বীরের বরণডালা।
মিলনলগ্ন বারে বারে ফিরে যায়
বরসজ্জার ব্যর্থতাবেদনায়,
মনে মনে সদা ব্যথিত কল্পনায়
তোমারে পরায় মালা।
তব রথ তারা স্বপ্নে দেখিছে জেগে,
ছুটিছে অশ্ব বিদ্যুৎকশা লেগে।
ঘুরিছে চক্র বহ্নিবরন সে যে,
উঠিছে শূন্যে ঘর্ঘর তার বেজে,
প্রোজ্জ্বল চূড়া প্রভাতসূর্যতেজে,
ধ্বজা রঞ্জিত রাঙা সন্ধ্যার মেঘে।
উদ্দেশহীন দুর্গম কোন্খানে
চল দুঃসহ দুঃসাহসের টানে।
দিল আহ্বান আলসনিদ্রা-নাশা
উদয়কূলের শৈলমূলের বাসা,
অমরালোকের নব আলোকের ভাষা
দীপ্ত হয়েছে দৃপ্ত তোমার প্রাণে।
অদূরে সুনীল সাগরে ঊর্মিরাশি
উত্তালবেগে উঠিছে সমুচ্ছ্বাসি।
পথিক ঝটিকা রুদ্রের অভিসারে
উধাও ছুটিছে সীমাসমুদ্রপারে,
উল্লোল কলগর্জিত পারাবারে
ফেনগর্গরে ধ্বনিছে অট্টহাসি।
আত্মলোপের নিত্যনিবিড় কারা,
তুমি উদ্দাম সেই বন্ধনহারা।
কোনো শঙ্কার কার্মূকটংকারে
পারে না তোমারে বিহ্বল করিবারে,
মৃত্যুর ছায়া ভেদিয়া তিমিরপারে
নির্ভয়ে ধাও যেথা জ্বলে ধ্রুবতারা।
চাহে নারী তব রথসঙ্গিনী হবে,
তোমার ধনুর তূণ চিহ্নিয়া লবে।
অবারিত পথে আছে আগ্রহভরে
তব যাত্রায় আত্মদানের তরে,
গ্রহণ করিয়ো সম্মানে সমাদরে--
জাগ্রত করি রাখিয়ো শঙ্খরবে।
-
১২ মাঘ, ১৩৩৮

অচেনা - তোমারে আমি কখনো চিনি নাকো,

অচেনা
- বিচিত্রিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
তোমারে আমি কখনো চিনি নাকো,
লুকানো নহ, তবু লুকানো থাকো।
ছবির মতো ভাবনা পরশিয়া
একটু আছ মনেরে হরষিয়া।
অনেক দিন দিয়েছ তুমি দেখা,
বসেছ পাশে, তবুও আমি একা।
আমার কাছে রহিলে বিদেশিনী,
লইলে শধু নয়ন মম জিনি।
বেদনা কিছু আছে বা তব মনে,
সে ব্যথা ঢাকে তোমারে আবরণে।
শূন্য-পানে চাহিয়া থাকো তুমি,
নিশ্বসিয়া উঠে কাননভূমি।
মৌন তব কী কথা বলে বুঝি,
অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি।
চলিয়া যাও তখন মনে বাজে--
চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।

পসারিনী - পসারিনী, ওগো পসারিনী, কেটেছে সকালবেলা হাটে হাটে লয়ে

• পসারিনী -
• বিচিত্রিতা
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
পসারিনী, ওগো পসারিনী,
কেটেছে সকালবেলা হাটে হাটে লয়ে বিকিকিনি।
ঘরে ফিরিবার খনে
কী জানি কী হল মনে,
বসিলি গাছের ছায়াতলে--
লাভের জমানো কড়ি
ডালায় রহিল পড়ি,
ভাবনা কোথায় ধেয়ে চলে।
এই মাঠ, এই রাঙা ধূলি,
অঘ্রানের-রৌদ্র-লাগা চিক্কণ কাঁঠালপাতাগুলি
শীতবাতাসের শ্বাসে
এই শিহরন ঘাসে--
কী কথা কহিল তোর কানে।
বহুদূর নদীজলে
আলোকের রেখা ঝলে,
ধ্যানে তোর কোন্ মন্ত্র আনে।
সৃষ্টির প্রথম স্মৃতি হতে
সহসা আদিম স্পন্দ সঞ্চরিল তোর রক্তস্রোতে।
তাই এ তরুতে তৃণে
প্রাণ আপনারে চিনে
হেমন্তের মধ্যাহ্নের বেলা--
মৃত্তিকার খেলাঘরে
কত যুগযুগান্তরে
হিরণে হরিতে তোর খেলা।
নিরালা মাঠের মাঝে বসি
সাম্প্রতের আবরণ মন হতে
গেল দ্রুত খসি।
আলোকে আকাশে মিলে
যে-নটন এ নিখিলে
দেখ তাই আঁখির সম্মুখে,
বিরাট কালের মাঝে
যে ওঙ্কারধ্বনি বাজে
গুঞ্জরি উঠিল তোর বুকে।
যত ছিল ত্বরিত আহ্বান
পরিচিত সংসারের দিগন্তে হয়েছে অবসান।
বেলা কত হল, তার
বার্তা নাহি চারিধার,
না কোথাও কর্মের আভাস।
শব্দহীনতার স্বরে
খররৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করে,
শূন্যতার উঠে দীর্ঘশ্বাস।
পসারিনী, ওগো পসারিনী,
ক্ষণকাল-তরে আজি ভুলে গেলি যত বিকিকিনি।
কোথা হাট, কোথা ঘাট,
কোথা ঘর, কোথা বাট,
মুখর দিনের কলকথা--
অনন্তের বাণী আনে
সর্বাঙ্গে সকল প্রাণে
বৈরাগ্যের স্তব্ধ ব্যাকুলতা।

Amaro Porano Jaha Chay – আমার পরান যাহা চায়,

আমার পরান যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর, কেহ নাই কিছু নাই গো।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও, সুখের সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে, তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো।

রাগ: পিলু
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১২৯৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1888
রচনাস্থান: কলকাতা, দার্জিলিং
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী,
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

Monday, January 18, 2016

Krishnakali Ami Tarei Boli - কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার 'পরে দেয় নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
-
শিলাইদহ, ৪ আষাঢ়, ১৩০৭

Valobese Sokhe Nivite Jotone - ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো --

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো-- তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি-- তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥
মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী-- তোমার
কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার
ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-- তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-- তোমার
অতুল গৌরবে॥
-
রাগ: কীর্তন
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৮ আশ্বিন, ১৩০৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1897
রচনাস্থান: সাজাদপুর
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার