Thursday, March 31, 2016

শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা - প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি, ওগো পুরবাসী, কে রয়েছে জাগি,

শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা
- কথা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
অবদানশতক

অনাথপিণ্ডদ বুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন

"প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি,
ওগো পুরবাসী, কে রয়েছে জাগি,
অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদ-
নিনাদে।
সদ্য মেলিতেছে তরুণ তপন
আলস্যে অরুণ সহাস্য লোচন
শ্রাবস্তীপুরীর গগনলগন
প্রাসাদে।
বৈতালিকদল সুপ্তিতে শয়ান
এখনো ধরে নি মাঙ্গলিক গান,
দ্বিধাভরে পিক মৃদু কুহুতান
কুহরে।
ভিক্ষু কহে ডাকি, "হে নিদ্রিত পুর,
দেহো ভিক্ষা মোরে, করো নিদ্রা দূর'--
সুপ্ত পৌরজন শুনি সেই সুর
শিহরে।
সাধু কহে, "শুন, মেঘ বরিষার
নিজেরে নাশিয়া দেয় বৃষ্টিধার,
সর্ব ধর্মমাঝে ত্যাগধর্ম সার
ভুবনে।'
কৈলাসশিখর হতে দূরাগত
ভৈরবের মহাসংগীতের মতো
সে বাণী মন্দ্রিল সুখতন্দ্রারত
ভবনে।
রাজা জাগি ভাবে বৃথা রাজ্য ধন,
গৃহী ভাবে মিছা তুচ্ছ আয়োজন,
অশ্রু অকারণে করে বিসর্জন
বালিকা।
যে ললিত সুখে হৃদয় অধীর
মনে হল তাহা গত যামিনীর
স্খলিত দলিত শুষ্ক কামিনীর
মালিকা।
বাতায়ন খুলে যায় ঘরে ঘরে,
ঘুমভাঙা আঁখি ফুটে থরে থরে
অন্ধকার পথ কৌতূহলভরে
নেহারি।
"জাগো, ভিক্ষা দাও' সবে ডাকি ডাকি
সুপ্ত সৌধে তুলি নিদ্রাহীন আঁখি
শূন্য রাজবাটে চলেছে একাকী
ভিখারি।
ফেলি দিল পথে বণিকধনিকা
মুঠি মুঠি তুলি রতনকণিকা--
কেহ কণ্ঠহার, মাথার মণিকা
কেহ গো।
ধনী স্বর্ণ আনে থালি পূরে পূরে,
সাধু নাহি চাহে, পড়ে থাকে দূরে--
ভিক্ষু কহে, "ভিক্ষা আমার প্রভুরে
দেহো গো।'
বসনে ভূষণে ঢাকি গেল ধূলি,
কনকে রতনে খেলিল বিজুলি,
সন্ন্যাসী ফুকারে লয়ে শূন্য ঝুলি
সঘনে--
"ওগো পৌরজন, করো অবধান,
ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ তিনি বুদ্ধ ভগবান,
দেহো তারে নিজ সর্বশ্রেষ্ঠ দান
যতনে।'
ফিরে যায় রাজা, ফিরে যায় শেঠ,
মিলে না প্রভুর যোগ্য কোনো ভেট,
বিশাল নগরী লাজে রহে হেঁট-
আননে।
রৌদ্র উঠে ফুটে, জেগে উঠে দেশ,
মহানগরীর পথ হল শেষ,
পুরপ্রান্তে সাধু করিলা প্রবেশ
কাননে।
দীন নারী এক ভূতলশয়ন
না ছিল তাহার অশন ভূষণ,
সে আসি নমিল সাধুর চরণ-
কমলে।
অরণ্য-আড়ালে রহি কোনোমতে
একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে,
বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে
ভূতলে।
ভিক্ষু ঊর্ধ্বভুজে করে জয়নাদ--
কহে, "ধন্য মাতঃ, করি আশীর্বাদ,
মহাভিক্ষুকের পুরাইলে সাধ
পলকে।'
চলিলা সন্ন্যাসী ত্যজিয়া নগর
ছিন্ন চীরখানি লয়ে শিরোপর
সঁপিতে বুদ্ধের চরণনখর-
আলোকে।
-
৫ কার্তিক, ১৩০৪

Wednesday, March 30, 2016

প্রতিনিধি - বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দুর্গভালে শিবাজি হেরিলা এক দিন--

প্রতিনিধি
- কথা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
অ্যাক্ওয়ার্থ্ সাহেব কয়েকটি মারাঠি গাথার যে ইংরাজি
অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন তাহারই ভূমিকা হইতে বর্ণিত
ঘটনা গৃহীত। শিবাজির গেরুয়া পতাকা "ভগোয়া ঝেণ্ডা' নামে
খ্যাত।
-
বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দুর্গভালে
শিবাজি হেরিলা এক দিন--
রামদাস গুরু তাঁর ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার
ফিরিছেন যেন অন্নহীন।
ভাবিলা, এ কী এ কাণ্ড!          গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড--
ঘরে যাঁর নাই দৈন্যলেশ!
সব যাঁর হস্তগত,                   রাজ্যেশ্বর পদানত,
তাঁরো নাই বাসনার শেষ!
এ কেবল দিনে রাত্রে              জল ঢেলে ফুটা পাত্রে
বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।
কহিলা, "দেখিতে হবে কতখানি দিলে তবে
ভিক্ষাঝুলি ভরে একেবারে।'
তখনি লেখনী আনি                কী লিখি দিলা কী জানি,
বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে,
"গুরু যবে ভিক্ষা-আশে            আসিবেন দুর্গ-পাশে
এই লিপি দিয়ো তাঁর পায়ে।'
গুরু চলেছেন গেয়ে, সম্মুখে চলেছে ধেয়ে
কত পান্থ কত অশ্বরথ!--
"হে ভবেশ, হে শংকর, সবারে দিয়েছ ঘর,
আমারে দিয়েছ শুধু পথ।
অন্নপূর্ণা মা আমার লয়েছে বিশ্বের ভার,
সুখে আছে সর্ব চরাচর--
মোরে তুমি, হে ভিখারি,          মার কাছ হতে কাড়ি
করেছ আপন অনুচর।'
সমাপন করি গান                  সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান
দুর্গদ্বারে আসিয়া যখন--
বালাজি নমিয়া তাঁরে              দাঁড়াইল এক ধারে
পদমূলে রাখিয়া লিখন।
গুরু কৌতূহলভরে                 তুলিয়া লইলা করে,
পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি--
বন্দি তাঁর পাদপদ্ম শিবাজি সঁপিছে অদ্য
তাঁরে নিজরাজ্য-রাজধানী।
পরদিনে রামদাস                  গেলেন রাজার পাশ,
কহিলেন, "পুত্র, কহো শুনি,
রাজ্য যদি মোরে দেবে            কী কাজে লাগিবে এবে--
কোন্ গুণ আছে তব গুণী?'
"তোমারি দাসত্বে প্রাণ আনন্দে করিব দান'
শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে।
গুরু কহে, "এই ঝুলি              লহ তবে স্কন্ধে তুলি,
চলো আজি ভিক্ষা করিবারে।'
শিবাজি গুরুর সাথে ভিক্ষাপাত্র লয়ে হাতে
ফিরিলে পুরদ্বারে-দ্বারে।
নৃপে হেরি ছেলেমেয়ে            ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে,
ডেকে আনে পিতারে মাতারে।
অতুল ঐশ্বর্যে রত,                তাঁর ভিখারির ব্রত!
এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা!
ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে,          হস্ত কাঁপে থরেথরে,
ভাবে ইহা মহতের লীলা।
দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে,                ক্ষান্ত দিয়া কর্মকাজে
বিশ্রাম করিছে পুরবাসী।
একতারে দিয়ে তান               রামদাস গাহে গান
আনন্দে নয়নজলে ভাসি,
"ওহে ত্রিভুবনপতি,                বুঝি না তোমার মতি,
কিছুই অভাব তব নাহি--
হৃদয়ে হৃদয়ে তবু                  ভিক্ষা মাগি ফির, প্রভু,
সবার সর্বস্বধন চাহি।'
অবশেষে দিবসান্তে                নগরের এক প্রান্তে
নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি--
ভিক্ষা-অন্ন রাঁধি সুখে             গুরু কিছু দিলা মুখে,
প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি।
রাজা তবে কহে হাসি, "নৃপতির গর্ব নাশি
করিয়াছ পথের ভিক্ষুক--
প্রস্তুত রয়েছে দাস,                আরো কিবা অভিলাষ--
গুরু-কাছে লব গুরু দুখ।'
গুরু কহে, "তবে শোন্,করিলি কঠিন পণ,
অনুরূপ নিতে হবে ভার--
এই আমি দিনু কয়ে               মোর নামে মোর হয়ে
রাজ্য তুমি লহ পুনর্বার।
তোমারে করিল বিধি              ভিক্ষুকের প্রতিনিধি,
রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন।
পালিবে যে রাজধর্ম                জেনো তাহা মোর কর্ম,
রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন।'
"বৎস, তবে এই লহো            মোর আশীর্বাদসহ
আমার গেরুয়া গাত্রবাস--
বৈরাগীর উত্তরীয়                  পতাকা করিয়া নিয়ো'
কহিলেন গুরু রামদাস।
নৃপশিষ্য নতশিরে বসি রহে নদীতীরে,
চিন্তারাশি ঘনায়ে ললাটে।
থামিল রাখালবেণু,                গোঠে ফিরে গেল ধেনু,
পরপারে সূর্য গেল পাটে।
পূরবীতে ধরি তান একমনে রচি গান
গাহিতে লাগিলা রামদাস,
"আমারে রাজার সাজে বসায়ে সংসারমাঝে
কে তুমি আড়ালে কর বাস!
হে রাজা, রেখেছি আনি তোমারি পাদুকাখানি,
আমি থাকি পাদপীঠতলে--
সন্ধ্যা হয়ে এল ওই, আর কত বসে রই!
তব রাজ্যে তুমি এসো চলে।'
-
৬ কার্তিক, ১৩০৪

Tuesday, March 22, 2016

ভগ্ন মন্দির - ভাঙা দেউলের দেবতা, তব বন্দনা রচিতে,

>>> ভগ্ন মন্দির <<<
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
ভাঙা দেউলের দেবতা,
তব বন্দনা রচিতে, ছিন্না
বীণার তন্ত্রী বিরতা।
সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ
তোমার আরতি-বারতা।
তব মন্দির স্থির গম্ভীর,
ভাঙা দেউলের দেবতা!
তব জনহীন ভবনে
থেকে থেকে আসে ব্যাকুল গন্ধ
নববসন্তপবনে।
যে ফুলে রচেনি পূজার অর্ঘ্য,
রাখে নি ও রাঙা চরণে,
সে ফুল ফোটার আসে সমাচার
জনহীন ভাঙা ভবনে।
পূজাহীন তব পূজারি
কোথা সারাদিন ফিরে উদাসীন
কার প্রসাদের ভিখারি!
গোধূলিবেলায় বনের ছায়ায়
চির-উপবাস-ভূখারি
ভাঙা মন্দিরে আসে ফিরে ফিরে
পূজাহীন তব পূজারি।
ভাঙা দেউলের দেবতা,
কত উৎসব হইল নীরব,
কত পূজানিশা বিগতা।
কত বিজয়ায় নবীন প্রতিমা
কত যায় কত কব তা--
শুধু চিরদিন থাকে সেবাহীন
ভাঙা দেউলের দেবতা।

Monday, March 21, 2016

বসন্ত - অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে মত্ত কুতূহলী,

>>> বসন্ত <<<
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটিরপ্রাঙ্গণে
পীতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উন্মাদ পবনে
মন্দারমঞ্জরী,
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু--
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।
সখা, সেই অতিদূর সদ্যোজাত আদি মধুমাসে
তরুণ ধরায়
এনেছিলে যে কুসুম ডুবাইয়া তপ্ত কিরণের
স্বর্ণমদিরায়,
সেই পুরাতন সেই চিরন্তন অনন্ত প্রবীণ
নব পুষ্পরাজি
বর্ষে বর্ষে আনিয়াছ-- তাই লয়ে আজো পুনর্বার
সাজাইলে সাজি।
তাই সে পুষ্পে লিখা জগতের প্রাচীন দিনের
বিস্মৃত বারতা,
তাই তার গন্ধে ভাসে ক্লান্ত লুপ্ত লোকলোকান্তের
কান্ত মধুরতা।
তাই আজি প্রস্ফুটিত নিবিড় নিকুঞ্জবন হতে
উঠিছে উচ্ছ্বাসি
লক্ষ দিনযামিনীর যৌবনের বিচিত্র বেদনা,
অশ্রু গান হাসি।
যে মালা গেঁথেছি আজি তোমারে সঁপিতে উপহার
তারি দলে দলে
নামহারা নায়িকার পুরাতন আকাঙক্ষাকাহিনী
আঁকা অশ্রুজলে।
সযত্নসেচনসিক্ত নবোন্মুক্ত এই গোলাপের
রক্ত পত্রপুটে
কম্পিত কুণ্ঠিত কত অগণ্য চুম্বন-ইতিহাস
রহিয়াছে ফুটে।
আমার বসন্তরাতে চারি চক্ষে জেগে উঠেছিল
যে-কয়টি কথা,
তোমার কুসুমগুলি হে বসন্ত, সে গুপ্ত সংবাদ
নিয়ে গেল কোথা?
সে চম্পক, সে বকুল, সে চঞ্চল চকিত চামেলি
স্মিত শুভ্রমুখী,
তরুণী রজনীগন্ধা আগ্রহে উৎসুক-উন্নমিতা,
একান্ত কৌতুকী,
কয়েক বসন্তে তারা আমার যৌবনকাব্যগাথা
লয়েছিল পড়ি।
কণ্ঠে কণ্ঠে থাকি তারা শুনেছিল দুটি বক্ষোমাঝে
বাসনা-বাঁশরি।
ব্যর্থ জীবনের সে কয়খানি পরম অধ্যায়
ওগো মধুমাস,
তোমার কুসুমগন্ধে বর্ষে বর্ষে শূন্যে জলে স্থলে
হইবে প্রকাশ।
বকুলে চম্পকে তারা গাঁথা হয়ে নিত্য যাবে চলি
যুগে যুগান্তরে,
বসন্তে বসন্তে তারা কুঞ্জে কুঞ্জে উঠিবে আকুলি
কুহুকলস্বরে।
অমর বেদনা মোর হে বসন্ত, রহি গেল তব
মর্মরনিশ্বাসে--
উত্তপ্ত যৌবনমোহ রক্তরৌদ্রে রহিল রঞ্জিত
চৈত্রসন্ধ্যাকাশে।

Sunday, March 20, 2016

অনবচ্ছিন্ন আমি - আজি মগ্ন হয়েছিনু ব্রহ্মাণ্ডমাঝারে;

অনবচ্ছিন্ন আমি
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
আজি মগ্ন হয়েছিনু ব্রহ্মাণ্ডমাঝারে;
যখন মেলিনু আঁখি, হেরিনু আমারে।
ধরণীর বস্ত্রাঞ্চল দেখিলাম তুলি,
আমার নাড়ীর কম্পে কম্পমান ধূলি।
অনন্ত-আকাশ-তলে দেখিলাম নামি,
আলোক-দোলায় বসি দুলিতেছি আমি।
আজি গিয়েছিনু চলি মৃত্যুপরপারে,
সেথা বৃদ্ধ পুরাতন হেরিনু আমারে।
অবিচ্ছিন্ন আপনারে নিরখি ভুবনে
শিহরি উঠিনু কাঁপি আপনার মনে।
জলে স্থলে শূন্যে আমি যত দূরে চাই
আপনারে হারাবার নাই কোনো ঠাঁই।
জলস্থল দূর করি ব্রহ্ম অন্তর্যামী,
হেরিলাম তার মাঝে স্পন্দমান আমি।
-
১৩০৬

অসময় - হয়েছে কি তবে সিংহদুয়ার বন্ধ রে

•• অসময়
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
হয়েছে কি তবে সিংহদুয়ার বন্ধ রে?
এখনো সময় আছে কি, সময় আছে কি?
দূরে কলরব ধ্বনিছে মন্দ মন্দ রে--
ফুরালো কি পথ, এসেছি পুরীর কাছে কি?
মনে হয় সেই সুদূর মধুর গন্ধ রে
রহি রহি যেন ভাসিয়া আসিছে বাতাসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।
ওই কি প্রদীপ দেখা যায় পুরমন্দিরে?
ও যে দুটি তারা দূর পশ্চিমগগনে।
ও কি শিঞ্জিত ধ্বনিছে কনকমঞ্জীরে?
ঝিল্লির রব বাজে বনপথে সঘনে।
মরীচিকালেখা দিগন্তপথ রঞ্জি রে
সারাদিন আজি ছলনা করেছে হতাশে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।
এতদিনে সেথা বনবনান্ত নন্দিয়া
নব বসন্তে এসেছে নবীন ভূপতি।
তরুণ আশার সোনার প্রতিমা বন্দিয়া
নব আনন্দে ফিরিছে যুবক যুবতী।
বীণার তন্ত্রী আকুল ছন্দে ক্রন্দিয়া
ডাকিছে সবারে আছে যারা দূর প্রবাসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।
আজিকে সবাই সাজিয়াছে ফুলচন্দনে,
মুক্ত আকাশে যাপিবে জ্যোৎস্নাযামিনী।
দলে দলে চলে বাঁধাবাঁধি বাহুবন্ধনে,
ধ্বনিছে শূন্যে জয়সংগীতরাগিণী।
নূতন পতাকা নূতন প্রাসাদপ্রাঙ্গণে
দক্ষিণবায়ে উড়িছে বিজয়বিলাসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।
সারা নিশি ধরে বৃথা করিলাম মন্ত্রণা,
শরৎ-প্রভাত কাটিল শূন্যে চাহিয়া।
বিদায়ের কালে দিতে গেনু কারে সান্ত্বনা,
যাত্রীরা হোথা গেল খেয়াতরী বাহিয়া।
আপনারে শুধু বৃথা করিলাম বঞ্চনা,
জীবন-আহুতি দিলাম কী আশাহুতাশে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।
প্রভাতে আমায় ডেকেছিল সবে ইঙ্গিতে,
বহুজনমাঝে লয়েছিল মোরে বাছিয়া--
যবে রাজপথ ধ্বনিয়া উঠিল সংগীতে
তখনো বারেক উঠেছিল প্রাণ নাচিয়া।
এখন কি আর পারিব প্রাচীর লঙ্ঘিতে,
দাঁড়ায়ে বাহিরে ডাকিব কাহারে বৃথা সে!
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে।
তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে,
দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে,
শান্তিসমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে।
দুয়ার-প্রান্তে দাঁড়ায়ে বাহির-প্রান্তরে
ভেরী বাজাইব মোর প্রাণপণ প্রয়াসে।
বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি,
এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিছে আকাশে।

Saturday, March 19, 2016

অশেষ - যত-কিছু ছিল কাজ সাঙ্গ তো করেছি আজ দীর্ঘ দীনমান।

>>> অশেষ <<<
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
যত-কিছু ছিল কাজ সাঙ্গ তো করেছি আজ
দীর্ঘ দীনমান।
জাগায়ে মাধবীবন চলে গেছে বহুক্ষণ
প্রত্যুষ নবীন,
প্রখর পিপাসা হানি পুষ্পের শিশির
টানি
গেছে মধ্যদিন।
মাঠের পশ্চিমশেষে অপরাহ্ন ম্লান
হেসে
হল অবসান,
পরপারে উত্তরিতে না দিয়েছি
তরণীতে--
আবার আহ্বান?
নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, সোনার আঁচল
খসা
হাতে দীপশিখা,
দিনের কল্লোল-'পর টানি দিল
ঝিল্লিস্বর
ঘন যবনিকা।
ও পারের কালো কূলে কালী ঘনাইয়া তুলে
নিশার কালিমা,
গাঢ় সে তিমিরতলে চক্ষু কোথা ডুবে চলে
নাহি পায় সীমা।
নয়নপল্লব-'পরে স্বপ্ন জড়াইয়া ধরে,
থেমে যায় গান।
ক্লান্তি টানে অঙ্গ মম প্রিয়ার মিনতি-
সম--
এখনো আহ্বান?
রে মোহিনী, রে নিষ্ঠুরা, ওরে রক্তলোভাতুরা
কঠোর স্বামিনী,
দিন মোর দিনু তোরে-- 
শেষ নিতে চাস হ'রে
আমার যামিনী?
জগতে সবারি আছে সংসারসীমার কাছে
কোনোখানে শেষ--
কেন আসে মর্মচ্ছেদি সকল সমাপ্তি ভেদি
তোমার আদেশ?
বিশ্বজোড়া অন্ধকার সকলেরি আপনার
একেলার স্থান--
কোথা হতে তারো মাঝে বিদ্যুতের মতো বাজে
তোমার আহ্বান?
দক্ষিণসমুদ্রপারে তোমার
প্রাসাদদ্বারে
হে জাগ্রত রানী,
বাজে না কি সন্ধ্যাকালে শান্ত সুরে
ক্লান্ত তালে
বৈরাগ্যের বাণী?
সেথায় কি মূক বনে ঘুমায় না পাখিগণে
আঁধার শাখায়?
তারাগুলি হর্ম্যশিরে উঠে নাকি ধীরে
ধীরে নিঃশব্দ পাখায়?
লতাবিতানের তলে বিছায় না পুষ্পদলে
নিভৃত শয়ান?
হে অশ্রান্ত শান্তিহীন, শেষ হয়ে গেল
দিন,
এখনো আহ্বান?
রহিল রহিল তবে আমার আপন সবে,
আমার নিরালা--
মোর সন্ধ্যাদীপালোক,
পথ-চাওয়া দুটি চোখ,
যত্নে গাঁথা মালা।
খেয়াতরী যাক বয়ে গৃহ-ফেরা লোক লয়ে
ও পারের গ্রামে,
তৃতীয়ার ক্ষীণ শশী ধীরে পড়ে যাক খসি
কুটিরের বামে।
রাত্রি মোর, শান্তি মোর,
রহিল স্বপ্নের ঘোর,
সুস্নিগ্ধ নির্বাণ--
আবার চলিনু ফিরে বহি ক্লান্ত নতশিরে
তোমার আহ্বান।
বলো তবে কী বাজাব, ফুল দিয়ে কী সাজাব
তব দ্বারে আজ?
রক্ত দিয়ে কী লিখিব,
প্রাণ দিয়ে কী শিখিব,
কী করিব কাজ?
যদি আঁখি পড়ে ঢুলে, শ্লথ হস্ত যদি ভুলে
পূর্ব নিপুণতা,
বক্ষে নাহি পাই বল, চক্ষে যদি আসে জল,
বেধে যায় কথা,
চেয়ো নাকো ঘৃণাভরে,
কোরো নাকো অনাদরে
মোর অপমান--
মনে রেখো হে নিদয়ে,
মেনেছিনু অসময়ে তোমার আহ্বান।
সেবক আমার মতো রয়েছে সহস্র শত
তোমার দুয়ারে,
তাহারা পেয়েছে ছুটি, ঘুমায় সকলে জুটি
পথের দু ধারে।
শুধু আমি তোরে সেবি বিদায় পাই নে দেবী,
ডাক' ক্ষণে ক্ষণে--
বেছে নিলে আমারেই, দুরূহ সৌভাগ্য সেই
বহি প্রাণপণে।
সেই গর্বে জাগি রব সারারাত্রি দ্বারে
তব অনিদ্র-নয়ান,
সেই গর্বে কণ্ঠে মম বহি বরমাল্যসম
তোমার আহ্বান।
হবে, হবে, হবে জয়--
হে দেবী, করি নে ভয়,
হব আমি জয়ী।
তোমার আহ্বানবাণী সফল করিব রানী,
হে মহিমাময়ী।
কাঁপিবে না ক্লান্ত কর,
ভাঙিবে না কণ্ঠস্বর,
টুটিবে না বীণা--
নবীন প্রভাত লাগি দীর্ঘরাত্রি রব জাগি,
দীপ নিবিবে না।
কর্মভার নবপ্রাতে নবসেবকের হাতে
করি যাব দান--
মোর শেষ কণ্ঠস্বরে যাইব ঘোষণা করে
তোমার আহ্বান।
-
২৫ বৈশাখ ১৩০৬

Thursday, March 17, 2016

নববিরহ - হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে--

নববিরহ
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে--
অধর করুণামাখা
মিনতি-বেদনা-আঁকা
নীরবে চাহিয়া থাকা
বিদায়খনে
হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে।
ঝরো ঝরো ঝরে জল, বিজুলি হানে,
পবন মাতিছে বনে পাগল গানে।
আমার পরানপুটে
কোন্খানে ব্যথা ফুটে,
কার কথা বেজে উঠে
হৃদয়কোণে
হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে।
-
ইছামতী, ৬ আশ্বিন, ১৩০৪

Tuesday, March 15, 2016

লজ্জিতা - যামিনী না যেতে জাগালে না কেন,

লজ্জিতা
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন,
বেলা হল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে
চলিব পথের মাঝে!
আলোকপরশে মরমে মরিয়া
হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া
কামিনী শিথিল সাজে।
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন,
বেলা হল মরি লাজে।
নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ
উষার বাতাস লাগি।
রজনীর শশী গগনের কোণে
লুকায় শরণ মাগি।
পাখি ডাকি বলে "গেল বিভাবরী,
বধূ চলে জলে লইয়া গাগরি,
আমি এ আকুল কবরী আবরি
কেমনে যাইব কাজে!
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন,
বেলা হল মরি লাজে।
-
যমুনা, ৭ আশ্বিন, ১৩০৪

সকরুণা - সখী প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে

সকরুণা
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
সখী প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে!
তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে।
যদি শুধায় কে দিল, কোন্ ফুলকাননে,
তোর শপথ, আমার নামটি বলিস নে।
সখী প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে!
সখী, তরুর তলায় বসে সে ধুলায় যে!
সেথা বকুলমালায় আসন বিছায়ে দে।
সে যে করুণা জাগায় সকরুণ নয়নে--
কেন কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।
সখী প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে!
-
নাগর নদী । মেঘবৃষ্টি । অমাবস্যা,
১০ আশ্বিন, ১৩০৪

Monday, March 14, 2016

মদনভস্মের পর - পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী,

মদনভস্মের পর
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
ভরিয়া উঠে নিখিল ভব  রতিবিলাপ-সংগীতে,
সকল দিক কাঁদিয়া উঠে আপনি।
ফাগুন মাসে নিমেষ-মাঝে না জানি কার ইঙ্গিতে
শিহরি উঠি মুরছি পড়ে অবনী।
আজিকে তাই বুঝিতে নারি কিসের বাজে যন্ত্রণা
হৃদয়বীণাযন্ত্রে মহা পুলকে!
তরুণী বসি ভাবিয়া মরে কী দেয় তারে মন্ত্রণা
মিলিয়া সবে দ্যুলোকে আর ভূলোকে
কী কথা উঠে মর্মরিয়া বকুলতরুপল্লবে,
ভ্রমর উঠে গুঞ্জরিয়া কী ভাষা!
ঊর্ধ্বমুখে সূর্যমুখী স্মরিছে কোন্ বল্লভে,
নির্ঝরিণী বহিছে কোন্ পিপাসা!
বসন কার দেখিতে পাই জ্যোৎস্নালোকে লুণ্ঠিত
নয়ন কার নীরব নীল গগনে!
বদন কার দেখিতে পাই কিরণে অবগুণ্ঠিত,
চরণ কার কোমল তৃণশয়নে!
পরশ কার পুষ্পবাসে পরান মন উল্লাসি
হৃদয়ে উঠে লতার মতো জড়ায়ে!
পঞ্চশরে ভস্ম করে করেছ একি সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
-
১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৪

Sunday, March 13, 2016

ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ - যে তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে,

ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
যে তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে,
হে মোর স্বদেশ,
মোরা তারি কাছে ফিরি সম্মানের তরে
পরি তারি বেশ।
বিদেশী জানে না তোরে অনাদরে তাই
করে অপমান,
মোরা তারি পিছে থাকি যোগ দিতে চাই
আপন সন্তান।
তোমার যা দৈন্য, মাতঃ, তাই ভূষা মোর
কেন তাহা ভুলি?
পরধনে ধিক্ গর্ব, করি করজোড়
ভরি ভিক্ষাঝুলি!
পুণ্যহস্তে শাক-অন্ন তুলে দাও পাতে
তাই যেন রুচে,
মোটা বস্ত্র বুনে দাও যদি নিজহাতে
তাহে লজ্জা ঘুচে।
সেই সিংহাসন--যদি অঞ্চলটি পাত,
কর স্নেহ দান।
যে তোমারে তুচ্ছ করে সে আমারে, মাতঃ,
কী দিবে সম্মান!
-
১৩০৪

Saturday, March 12, 2016

হতভাগ্যের গান - কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস --

হতভাগ্যের গান
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
বিভাস । একতালা

বন্ধু,
    কিসের তরে অশ্রু ঝরে,
কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস!
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে
করব মোরা পরিহাস।
রিক্ত যারা সর্বহারা
সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,
গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর
নয়কো তারা ক্রীতদাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
আমার সুখের স্ফীত বুকের
ছায়ার তলে নাহি চরি।
আমার দুখের বক্র মুখের
চক্র দেখে ভয় না করি।
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য
বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য।
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে
ভিন্ন করব নীলাকাশ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
হে অলক্ষ্মী, রুক্ষকেশী
তুমি দেবী অচঞ্চলা।
তোমার রীতি সরল অতি,
নাহি জান ছলাকলা।
জ্বালাও পেটে অগ্নিকণা
নাইকো তাহে প্রতারণা,
টান যখন মরণ-ফাঁসি
বল নাকো মিষ্টভাষ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
ধরায় যারা সেরা সেরা
মানুষ তারা তোমার ঘরে।
তাদের কঠিন শয্যাখানি
তাই পেতেছ মোদের তরে।
আমরা বরপুত্র তব
যাহাই দিবে তাহাই লব,
তোমায় দিব ধন্যধ্বনি
মাথায় বহি সর্বনাশ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
যৌবরাজ্যে বসিয়ে দে মা,
লক্ষ্মীছাড়ার সিংহাসনে।
ভাঙা কুলোয় করুক পাখা
তোমার যত ভৃত্যগণে।
দগ্ধভালে প্রলয়-শিখা
দিক্, মা, এঁকে তোমার টিকা--
পরাও সজ্জা লজ্জাহারা
জীর্ণকন্থা ছিন্নবাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
লুকোক তোমার ডঙ্কা শুনে
কপট সখার শূন্য হাসি।
পালাক ছুটে পুচ্ছ তুলে
মিথ্যে চাটু মক্কা কাশী।
আত্মপরের প্রভেদ-ভোলা
জীর্ণ দুয়োর নিত্য খোলা,
থাকবে তুমি থাকব আমি
সমান-ভাবে বারো মাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
শঙ্কা তরাস লজ্জা-শরম
চুকিয়ে দিলেম স্তুতি-নিন্দে।
ধুলো, সে তোর পায়ের ধুলো,
তাই মেখেছি ভক্তবৃন্দে।
আশারে কই, "ঠাকুরাণী,
তোমার খেলা অনেক জানি,
যাহার ভাগ্যে সকল ফাঁকি
তারেও ফাঁকি দিতে চাস!'
হাস্যমুখে অদৃষ্টরে
করব মোরা পরিহাস।
মৃত্যু যেদিন বলবে "জাগো,
প্রভাত হল তোমার রাতি',
নিবিয়ে যাব আমার ঘরের
চন্দ্র সূর্য দুটো বাতি।
আমরা দোঁহে ঘেঁষাঘেঁষি
চিরদিনের প্রতিবেশী,
বন্ধুভাবে কণ্ঠে সে মোর
জড়িয়ে দেবে বাহুপাশ,
বিদায়-কালে অদৃষ্টরে
করে যাব পরিহাস।
-
বড়ল নদী । ৭ আশ্বিন, ১৩০৪।
পরিবর্ধন: নাগর নদী। পতিসর
৭ আষাঢ় ১৩০৫

Thursday, March 10, 2016

বঙ্গলক্ষ্মী - তোমার মাঠের মাঝে, তব নদীতীরে,

>>> বঙ্গলক্ষ্মী <<<
- কল্পনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
তোমার মাঠের মাঝে, তব নদীতীরে,
তব আম্রবনে-ঘেরা সহস্র কুটিরে,
দোহনমুখর গোষ্ঠে, ছায়াবটমূলে,
গঙ্গার পাষাণঘাটে দ্বাদশ দেউলে,
হে নিত্যকল্যাণী লক্ষ্মী, হে বঙ্গজননী,
আপন অজস্র কাজ করিছ আপনি
অহর্নিশি হাস্যমুখে।
এ বিশ্বসমাজে
তোমার পুত্রের হাত নাহি কোনো কাজে
নাহি জান সে বারতা, তুমি শুধু, মা গো,
নিদ্রিত শিয়রে তার নিশিদিন জাগ
মলয় বীজন করি। রয়েছ, মা, ভুলি
তোমার শ্রীঅঙ্গ হতে একে একে খুলি
সৌভাগ্যভূষণ তব, হাতের কঙ্কণ,
তোমার ললাটশোভা সীমন্তরতন,
তোমার গৌরব, তারা বাঁধা রাখিয়াছে
বহুদূর বিদেশের বণিকের কাছে।
নিত্যকর্মে রত শুধু, অয়ি মাতৃভূমি,
প্রত্যুষে পূজার ফুল ফুটাইছ তুমি,
মধ্যাহ্নে পল্লবাঞ্চল প্রসারিয়া ধরি
রৌদ্র নিবারিছ, যবে আসে বিভাবরী
চারি দিক হতে তব যত নদনদী
ঘুম পাড়াবার গান গাহে নিরবধি
ঘেরি ক্লান্ত গ্রামগুলি শত বাহুপাশে।
শরৎ-মধ্যাহ্নে আজি স্বল্প অবকাশে
ক্ষণেক বিরাম দিয়া পুণ্য গৃহকাজে
হিল্লোলিত হৈমন্তিক মঞ্জরীর মাঝে
কপোতকূজনাকুল নিস্তব্ধ প্রহরে
বসিয়া রয়েছ মাতঃ, প্রফুল্ল অধরে
বাক্যহীন প্রসন্নতা; স্নিগ্ধ আঁখিদ্বয়
ধৈর্যশান্ত দৃষ্টিপাতে চতুর্দিক্ময়
ক্ষমাপূর্ণ আশীর্বাদ করে বিকিরণ।
হেরি সেই স্নেহপ্লুত আত্মবিস্মরণ,
মধুর মঙ্গলচ্ছবি মৌন অবিচল,
নতশির কবিচক্ষে ভরি আসে জল।