Monday, February 29, 2016

একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি --

একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি--
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥
যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।
যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে,
তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি॥
-
রাগ: কালাংড়া
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২ ফাল্গুন, ১৩৩৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

গানের সাজি - গানের সাজি এনেছি আজি, ঢাকাটি তার লও গো খুলে --

গানের সাজি
- পূরবী
-
গানের সাজি এনেছি আজি,
ঢাকাটি তার লও গো খুলে--
দেখো তো চেয়ে কী আছে।
যে থাকে মনে স্বপন-বনে
ছায়ার দেশে ভাবের কূলে
সে বুঝি কিছু দিয়াছে।
কী যে সে তাহা আমি কি জানি,
ভাষায়-চাপা কোন্ সে বাণী
সুরের ফুলে গন্ধখানি
ছন্দে বাঁধি গিয়াছে--
সে ফুল বুঝি হয়েছে পুঁজি,
দেখো তো চেয়ে কী আছে।
দেখো তো, সখী দিয়েছে ও কি
সুখের কাঁদা, দুখের হাসি,
দুরাশাভরা চাহনি।
দিয়েছে কি না ভোরের বীণা,
দিয়েছে কি সে রাতের বাঁশি
গহন-গান-গাহনি।
বিপুল ব্যথা ফাগুন-বেলা,
সোহাগ কভু, কভু বা হেলা,
আপন মনে আগুন-খেলা
পরানমন-দাহনি--
দেখো তো ডালা, সে স্মৃতি-ঢালা
আছে আকুল চাহনি?
ডেকেছ কবে মধুর রবে,
মিটালে কবে প্রাণের ক্ষুধা
তোমার করপরশে,
সহসা এসে করুণ হেসে
কখন চোখে ঢালিলে সুধা
ক্ষণিক  তব দরশে--
বাসনা জাগে নিভৃতে চিতে
সে-সব দান ফিরায়ে দিতে
আমার দিনশেষের গীতে--
সফল তারে করো-সে।
গানের সাজি খোলো গো আজি
করুণ করপরশে।
রসে বিলীন সে-সব দিন
ভরেছে আজি বরণডালা
চরম তব বরণে!
সুরের ডোরে গাঁথনি করে
রচিয়া মম বিরহমালা
রাখিয়া যাব চরণে।
একদা তব মনে না রবে,
স্বপনে এরা মিলাবে কবে,
তাহারি আগে মরুক তবে
অমৃতময় মরণে
ফাগুনে তোরে বরণ করে
সকল শেষ বরণে।
-
ফাল্গুন ১৩৩০

RabindraNath Tagore Image Post 2

RabindraNath Tagore

facebook Rabindra RachanaBali - রবীন্দ্র রচনাবলী
-
Twitter - Rabindra RachanaBali - রবীন্দ্র রচনাবলী
-

মাটির ডাক - শালবনের ওই আঁচল ব্যেপে যেদিন হাওয়া উঠত

মাটির ডাক
- পূরবী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শালবনের ওই আঁচল ব্যেপে
যেদিন হাওয়া উঠত খেপে
ফাগুন-বেলার বিপুল ব্যাকুলতায়,
যেদিন দিকে দিগন্তরে
লাগত পুলক কী মন্তরে
কচি পাতার প্রথম কলকথায়,
সেদিন মনে হত কেন
ওই ভাষারই বাণী যেন
লুকিয়ে আছে হৃদয়কুঞ্জছায়ে;
তাই অমনি নবীন রাগে
কিশলয়ের সাড়া লাগে
শিউরে-ওঠা আমার সারা গায়ে।
আবার যেদিন আশ্বিনেতে
নদীর ধারে ফসল-খেতে
সূর্য-ওঠার রাঙা-রঙিন বেলায়
নীল আকাশের কূলে কূলে
সবুজ সাগর উঠত দুলে
কচি ধানের খামখেয়ালি খেলায়--
সেদিন আমার হত মনে
ওই সবুজের নিমন্ত্রণে
যেন আমার প্রাণের আছে দাবি;
তাই তো হিয়া ছুটে পালায়
যেতে তারি যজ্ঞশালায়,
কোন্ ভুলে হায় হারিয়েছিল চাবি।


কার কথা এই আকাশ বেয়ে
ফেলে আমার হৃদয় ছেয়ে,
বলে দিনে, বলে গভীর রাতে--
"যে-জননীর কোলের 'পরে
জন্মেছিলি মর্ত-ঘরে,
প্রাণ ভরা তোর যাহার বেদনাতে,
তাহার বক্ষ হতে তোরে
কে এনেছে হরণ করে,
ঘিরে তোরে রাখে নানান পাকে।
বাঁধন-ছেঁড়া তোর সে নাড়ী
সইবে না এই ছাড়াছাড়ি,
ফিরে ফিরে চাইবে আপন মাকে।'
শুনে আমি ভাবি মনে
তাই ব্যথা এই অকারণে,
প্রাণের মাঝে তাই তো ঠেকে ফাঁকা,
তাই বাজে কার করুণ সুরে--
"গেছিস দূরে অনেক দূরে',
কী যেন তাই চোখের 'পরে ঢাকা।
তাই এতদিন সকল খানে
কিসের অভাব জাগে প্রাণে
ভালো করে পাই নি তাহা বুঝে;
ফিরেছি তাই নানামতে
নানান হাটে নানান পথে
হারানো কোল কেবল খুঁজে খুঁজে।


আজকে খবর পেলেম খাঁটি -
মা আমার এই শ্যামল মাটি,
অন্নে ভরা শোভার নিকেতন;
অভ্রভেদী মন্দিরে তার
বেদী আছে প্রাণদেবতার,
ফুল দিয়ে তার নিত্য আরাধন।
এইখানে তার অঙ্ক-মাঝে
প্রভাতরবির শঙ্খ বাজে,
আলোর ধারায় গানের ধারা মেশে;
এইখানে সে পূজার কালে
সন্ধ্যারতির প্রদীপ জ্বালে
শান্ত মনে ক্লান্ত দিনের শেষে।
হেথা হতে গেলেম দূরে
কোথা যে ইঁটকাঠের পুরে
বেড়া-ঘেরা বিষম নির্বাসনে;
তৃপ্তি যে নাই, কেবল নেশা,
ঠেলাঠেলি, নাই তো মেশা,
আবর্জনা জমে উপার্জনে।
যন্ত্র-জাঁতায় পরান কাঁদায়,
ফিরি ধনের গোলকধাঁধায়,
শূন্যতারে সাজাই নানা সাজে;
পথ বেড়ে যায় ঘুরে ঘুরে,
লক্ষ্য কোথায় পালায় দূরে,
কাজ ফলে না অবকাশের মাঝে।


যাই ফিরে যাই মাটির বুকে,
যাই চলে যাই মুক্তি-সুখে,
ইঁটের শিকল দিই ফেলে দিই টুটে;
আজ ধরণী আপন হাতে
অন্ন দিলেন আমার পাতে,
ফল দিয়েছেন সাজিয়ে পত্রপুটে।
আজকে মাঠের ঘাসে ঘাসে
নিশ্বাসে মোর খবর আসে
কোথায় আছে বিশ্বজনের প্রাণ;
ছয় ঋতু ধায় আকাশ-তলায়,
তার সাথে আর আমার চলায়
আজ হতে না রইল ব্যবধান।
যে দূতগুলি গগনপারের,
আমার ঘরের রুদ্ধ দ্বারের
বাইরে দিয়েই ফিরে ফিরে যায়,
আজ হয়েছে খোলাখুলি
তাদের সাথে কোলাকুলি
মাঠের ধারে পথতরুর ছায়।
কী ভুল ভুলেছিলেম, আহা,
সব চেয়ে যা নিকট তাহা
সুদূর হয়ে ছিল এতদিন;
কাছেকে আজ পেলেম কাছে--
চার দিকে এই যে ঘর আছে
তার দিকে আজ ফিরল উদাসীন।
-
২৩ ফাল্গুন ১৩২৮

Sunday, February 28, 2016

পূরবী - যারা আমার সাঁঝ-সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো -

পূরবী
- পূরবী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
যারা আমার সাঁঝ-সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো
আপন হিয়ার পরশ দিয়ে; এই জীবনের সকল সাদা কালো
যাদের আলো-ছায়ার লীলা; সেই যে আমার আপন মানুষগুলি
নিজের প্রাণের স্রোতের 'পরে আমার প্রাণের ঝর্না নিল তুলি;
তাদের সাথে একটি ধারায় মিলিয়ে চলে, সেই তো আমার আয়ু,
নাই সে কেবল দিন-গণনার পাঁজির পাতায়, নয় সে নিশাস-বায়ু।
তাদের বাঁচায় আমার বাঁচা আপন সীমা ছাড়ায় বহু দূরে;
নিমেষগুলির ফল পেকে যায় নানা দিনের সুধার রসে পুরে;
অতীত কালের আনন্দরূপ বর্তমানের বৃন্ত-দোলায় দোলে--
গর্ভ হতে মুক্ত শিশু তবুও যেন মায়ের বক্ষে কোলে
বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের বাঁধন দিয়ে। তাই তো যখন শেষে
একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে
আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শীর্ণ জীবন মম
শুষ্ক রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণী-সম
শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্ত বারি স্রস্ত অবহেলায়।
তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের অপরাহ্নবেলায়
তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো--
বলে নে, "ভাই, এই যা দেখা, এই যা ছোঁওয়া এই ভালো এই
ভালো।
এই ভালো আজ এ সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গা-যমুনায়
ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়।
এই ভালো রে প্রাণের রঙ্গে এই আসঙ্গ সকল অঙ্গে মনে
পুণ্য ধরার ধুলো মাটি ফল হাওয়া জল তৃণ তরুর সনে।
এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান গাওয়া এই
ভাষায়--
তারার সাথে নিশীথ রাতে ঘুমিয়ে পড়া নূতন-প্রাতের আশায়।'

বিজয়ী - তখন তারা দৃপ্ত বেগের বিজয়-রথে ছুটছিল বীর মত্ত অধীর,

বিজয়ী
- পূরবী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
তখন তারা দৃপ্ত বেগের বিজয়-রথে
ছুটছিল বীর মত্ত অধীর, রক্তধূলির পথবিপথে।
তখন তাদের চতুর্দিকেই রাত্রিবেলার প্রহর যত
স্বপ্নে-চলার পথিক-মতো,
মন্দগমন ছন্দে লুটায় মন্থর কোন্ ক্লান্ত বায়ে;
বিহঙ্গগান শান্ত তখন অন্ধ রাতের পক্ষছায়ে।
মশাল তাদের রুদ্রজ্বালায় উঠল জ্বলে--
অন্ধকারের ঊর্ধ্বতলে
বহ্নিদলের রক্তকমল ফুটল প্রবল দম্ভভরে;
দূর-গগনের স্তব্ধ তারা মুগ্ধ ভ্রমর তাহার 'পরে।
ভাবল পথিক-- এই যে তাদের মশাল-শিখা,
নয় সে কেবল দণ্ডপলের মরীচিকা।
ভাবল তারা-- এই শিখাটাই ধ্রুবজ্যোতির তারার সাথে
মৃত্যুহীনের দখিন হাতে
জ্বলবে বিপুল বিশ্বতলে।
ভাবল তারা এই শিখারই ভীষণ বলে
রাত্রি-রানীর দুর্গ-প্রাচীর দগ্ধ হবে,
অন্ধকারের রুদ্ধ কপাট দীর্ণ করে ছিনিয়ে লবে
নিত্যকালের বিত্তরাশি;
ধরিত্রীকে করবে আপন ভোগের দাসী।
ওই বাজে রে ঘণ্টা বাজে।
চমকে উঠেই হঠাৎ দেখে অন্ধ ছিল তন্দ্রামাঝে।
আপ্নাকে হায় দেখছিল কোন্ স্বপ্নাবেশে
যক্ষপুরীর সিংহাসনে লক্ষমণির রাজার বেশে;
মহেশ্বরের বিশ্ব যেন লুঠ করেছে অট্ট হেসে।
শূন্যে নবীন সূর্য জাগে
ওই যে তাহার বিশ্ব-চেতন কেতন-আগে
জ্বলছে নূতন দীপ্তিরতন তিমির-মথন শুভ্ররাগে;
মশাল-ভস্ম লুপ্তি-ধুলায় নিত্যদিনের সুপ্তি মাগে।
আনন্দলোক দ্বার খুলেছে,
আকাশ পুলক-ময়--
জয় ভূলোকের, জয় দ্যুলোকের, জয় আলোকের জয়।

Saturday, February 27, 2016

আত্মপরিচয় - পর্ব ১

আত্মপরিচয় - পর্ব ১
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
আমার জীবনবৃত্তান্ত লিখিতে আমি অনুরুদ্ধ হইয়াছি।
এখানে আমি অনাবশ্যক বিনয় প্রকাশ করিয়া জায়গা
জুড়িব না। কিন্তু গোড়াতে এ কথা বলিতেই হইবে,
আত্মজীবনী লিখিবার বিশেষ ক্ষমতা বিশেষ
লোকেরই থাকে, আমার তাহা নাই। না থাকিলেও
ক্ষতি নাই, কারণ, আমার জীবনের বিস্তারিত
বর্ণনায় কাহারো কোনো লাভ দেখি না।

সেইজন্য এ স্থলে আমার জীবনবৃত্তান্ত হইতে
বৃত্তান্তটা বাদ দিলাম। কেবল, কাব্যের মধ্য দিয়া
আমার কাছে আজ আমার জীবনটা যেভাবে প্রকাশ
পাইয়াছে, তাহাই যথেষ্ট সংক্ষেপে লিখিবার
চেষ্টা করিব। ইহাতে যে অহমিকা প্রকাশ পাইবে
সেজন্য আমি পাঠকদের কাছে বিশেষ করিয়া ক্ষমা
প্রার্থনা করি।

আমার সুদীর্ঘকালের কবিতা লেখার ধারাটাকে
পশ্চাৎ ফিরিয়া যখন দেখি তখন ইহা স্পষ্ট
দেখিতে পাই--এ একটা ব্যাপার, যাহার উপরে
আমার কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। যখন লিখিতেছিলাম
তখন মনে করিয়াছি, আমিই লিখিতেছি বটে, কিন্তু
আজ জানি কথাটা সত্য নহে। কারণ, সেই
খণ্ডকবিতাগুলিতে আমার সমগ্র কাব্যগ্রন্থের
তাৎপর্য সম্পূর্ণ হয় নাই--সেই তাৎপর্যটি কী
তাহাও আমি পূর্বে জানিতাম না। এইরূপে পরিণাম
না জানিয়া আমি একটির সহিত একটি কবিতা
যোজনা করিয়া আসিয়াছি--তাহাদের প্রত্যেকের যে
ক্ষুদ্র অর্থ কল্পনা করিয়াছিলাম, আজ সমগ্রের
সাহায্যে নিশ্চয় বুঝিয়াছি, সে অর্থ অতিক্রম
করিয়া একটি অবিচ্ছিন্ন তাৎপর্য তাহাদের
প্রত্যেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া আসিয়াছিল।
তাই দীর্ঘকাল পরে একদিন লিখিয়াছিলাম--

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী!
আমি যাহা-কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই--
কোথা ভেসে যাই দূরে।

বিশ্ববিধির একটা নিয়ম এই দেখিতেছি যে, যেটা
আসন্ন, যেটা উপস্থিত, তাহাকে সে খর্ব করিতে
দেয় না। তাহাকে এ কথা জানিতে দেয় না যে, সে
একটা সোপানপরম্পরার অঙ্গ। তাহাকে বুঝাইয়া দেয়
যে, সে আপনাতে আপনি পর্যাপ্ত। ফুল যখন ফুটিয়া
ওঠে তখন মনে হয়, ফুলই যেন গাছের একমাত্র
লক্ষ্য--এম্নই তাহার সৌন্দর্য, এমনি তাহার সুগন্ধ
যে, মনে হয় যেন সে বনলক্ষ্মীর সাধনার চরমধন।
কিন্তু সে যে ফল ফলাইবার উপলক্ষমাত্র সে কথা
গোপনে থাকে--বর্তমানের গৌরবেই সে প্রফুল্ল,
ভবিষ্যৎ তাহাকে অভিভূত করিয়া দেয় না। আবার
ফলকে দেখিলে মনে হয়, সেই যেন সফলতার চূড়ান্ত;
কিন্তু ভাবী তরুর জন্য সে যে বীজকে গর্ভের মধ্যে
পরিণত করিয়া তুলিতেছে, এ কথা অন্তরালেই
থাকিয়া যায়। এমনি করিয়া প্রকৃতি ফুলের মধ্যে
ফুলের চরমতা, ফলের মধ্যে ফলের চরমতা রক্ষা
করিয়াও তাহাদের অতীত একটি পরিণামকে
অলক্ষ্যে অগ্রসর করিয়া দিতেছে।

কাব্যরচনাসম্বন্ধেও সেই বিশ্ববিধানই দেখিতে
পাই--অন্তত আমার নিজের মধ্যে তাহা উপলব্ধি
করিয়াছি। যখন যেটা লিখিতেছিলাম তখন
সেইটেকেই পরিণাম বলিয়া মনে করিয়াছিলাম।
এইজন্য সেইটুকু সমাধা করার কাজেই অনেক যত্ন ও
অনেক আনন্দ আকর্ষণ করিয়াছে। আমিই যে তাহা
লিখিতেছি এবং একটা-কোনো বিশেষ ভাব অবলম্বন
করিয়া লিখিতেছি, এ সম্বন্ধেও সন্দেহ ঘটে নাই।
কিন্তু আজ জানিয়াছি, সে-সকল লেখা উপলক্ষমাত্র--
তাহারা যে অনাগতকে গড়িয়া তুলিতেছে সেই
অনাগতকে তাহারা চেনেও না। তাহাদের রচয়িতার
মধ্যে আর-একজন কে রচনাকারী আছেন, যাঁহার
সম্মুখে সেই ভাবী তাৎপর্য প্রত্যক্ষ বর্তমান।
ফুৎকার বাঁশির এক-একটা ছিদ্রের মধ্য দিয়া এক-
একটা সুর জাগাইয়া তুলিতেছে এবং নিজের কর্তৃত্ব
উচ্চস্বরে প্রচার করিতেছে, কিন্তু কে সেই
বিচ্ছিন্ন সুরগুলিকে রাগিণীতে বাঁধিয়া
তুলিতেছে? ফুঁ সুর জাগাইতেছে বটে, কিন্তু ফুঁ তো
বাঁশি বাজাইতেছে না। সেই বাঁশি বাজাইতেছে
তাহার কাছে সমস্ত রাগরাগিণী বর্তমান আছে,
তাহার অগোচরে কিছুই নাই।

বলিতেছিলাম বসি এক ধারে
আপনার কথা আপন জনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনী যত;
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মতো।

এই শ্লোকটার মানে বোধ করি এই যে, যেটা
লিখিতে যাইতেছিলাম সেটা সাদা কথা, সেটা
বেশি কিছু নহে--কিন্তু সেই সোজা কথা, সেই আমার
নিজের কথার মধ্যে এমন একটা সুর আসিয়া পড়ে,
যাহাতে তাহা বড়ো হইয়া ওঠে, ব্যক্তিগত না হইয়া
বিশ্বের হইয়া ওঠে। সেই-যে সুরটা, সেটা তো
আমার অভিপ্রায়ের মধ্যে ছিল না। আমার পটে
একটা ছবি দাগিয়াছিলাম বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে-
সঙ্গে যে-একটা রঙ ফলিয়া উঠিল, সেই রঙ ও সে
রঙের তুলি তো আমার হাতে ছিল না।

নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়,
নূতন বেদনা বেজে ওঠে তায়
নূতন রাগিণীভরে।
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে।

আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি যখন আমার একটা ক্ষুদ্র কথা
বলিবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিলাম তখন কে
একজন উৎসাহ দিয়া কহিলেন, "বলো বলো, তোমার
কথাটাই বলো। ঐ কথাটার জন্যই সকলে হাঁ করিয়া
তাকাইয়া আছে।' এই বলিয়া তিনি শ্রোতৃবর্গের
দিকে চাহিয়া চোখ টিপিলেন; স্নিগ্ধ কৌতুকের
সঙ্গে একটুখানি হাসিলেন এবং আমারই কথার ভিতর
দিয়া কী-সব নিজের কথা বলিয়া লইলেন।

কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার,
কেহ এক বলে, কেহ বলে আর,
আমারে শুধায় বৃথা বার বার--
দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে গো তুমি, কোথা রয়েছে গোপনে
আমি মরিতেছি খুঁজি।

শুধু কি কবিতা-লেখার একজন কর্তা কবিকে অতিক্রম
করিয়া তাহার লেখনী চালনা করিয়াছেন? তাহা
নহে। সেইসঙ্গে ইহাও দেখিয়াছি যে, জীবনটা যে
গঠিত হইয়া উঠিতেছে, তাহার সমস্ত সুখদুঃখ,
তাহার সমস্ত যোগবিয়োগের বিচ্ছিন্নতাকে কে
একজন একটি অখণ্ড তাৎপর্যের মধ্যে গাঁথিয়া
তুলিতেছেন। সকল সময়ে আমি তাঁহার আনুকূল্য
করিতেছি কি না জানি না, কিন্তু আমার সমস্ত
বাধা-বিপত্তিকেও, আমার সমস্ত ভাঙাচোরাকেও
তিনি নিয়তই গাঁথিয়া জুড়িয়া দাঁড় করাইতেছেন।
কেবল তাই নয়, আমার স্বার্থ, আমার প্রবৃত্তি, আমার
জীবনকে যে অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করিতেছে
তিনি বারে বারে সে সীমা ছিন্ন করিয়া
দিতেছেন--তিনি সুগভীর বেদনার দ্বারা,
বিচ্ছেদের দ্বারা, বিপুলের সহিত, বিরাটের
সহিত তাহাকে যুক্ত করিয়া দিতেছেন। সে যখন
একদিন হাট করিতে বাহির হইয়াছিল তখন
বিশ্বমানবের মধ্যে সে আপনার সফলতা চায় নাই--
সে আপনার ঘরের সুখ ঘরের সম্পদের জন্যই কড়ি
সংগ্রহ করিয়াছিল। কিন্তু সেই মেঠো পথ, সেই
ঘোরো সুখদুঃখের দিক হইতে কে তাহাকে জোর
করিয়া পাহাড়-পর্বত অধিত্যকা-উপত্যকার
দুর্গমতার মধ্য দিয়া টানিয়া লইয়া যাইতেছে।

এ কী কৌতুক নিত্য-নূতন
ওগো কৌতুকময়ী!
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
চলিতে দিতেছে কই?
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে,
চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে,
গোঠে ধায় গোরু, বধূ জল আনে
শতবার যাতায়াতে--
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায়,
মনে ছিল দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,
ক্লান্ত হৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে।
কখনো উদার গিরির শিখরে
কভু বেদনার তমোগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের 'পরে
চলেছি পাগলবেশে।

এই যে কবি, যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার
সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার
জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাকেই আমার
কাব্যে আমি "জীবনদেবতা' নাম দিয়াছি। তিনি যে
কেবল আমার এই ইহজীবনের সমস্ত খণ্ডতাকে
ঐক্যদান করিয়া বিশ্বের সহিত তাহার
সামঞ্জস্যস্থাপন করিতেছেন, আমি তাহা মনে করি
না। আমি জানি, অনাদিকাল হইতে বিচিত্র বিস্মৃত
অবস্থার মধ্য দিয়া তিনি আমাকে আমার এই
বর্তমান প্রকাশের মধ্যে উপনীত করিয়াছেন--সেই
বিশ্বের মধ্য দিয়া প্রবাহিত অস্তিত্বধারার বৃহৎ
স্মৃতি তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া আমার অগোচরে
আমার মধ্যে রহিয়াছে। সেইজন্য এই জগতের
তরুলতা-পশুপক্ষীর সঙ্গে এমন একটা পুরাতন ঐক্য
অনুভব করিতে পারি, সেইজন্য এতবড়ো রহস্যময়
প্রকাণ্ড জগৎকে অনাত্মীয় ও ভীষণ বলিয়া মনে হয়
না।

আজ মনে হয় সকলেরি মাঝে
তোমারেই ভালোবেসেছি;
জনতা বাহিয়া চিরদিন ধরে
শুধু তুমি আমি এসেছি।
চেয়ে চারি দিক পানে
কী যে জেগে ওঠে প্রাণে--
তোমার-আমার অসীম মিলন
যেন গো সকলখানে।
কত যুগ এই আকাশে যাপিনু
সে কথা অনেক ভুলেছি,
তারায় তারায় যে আলো কাঁপিছে
সে আলোকে দোঁহে দুলেছি।
তৃণরোমাঞ্চ ধরণীর পানে
আশ্বিনে নব-আলোকে
চেয়ে দেখি যবে আপনার মনে
প্রাণ ভরি উঠে পুলকে।
মনে হয় যেন জানি
এই অকথিত বাণী--
মূক মেদিনীর মর্মের মাঝে
জাগিছে যে ভাবখানি।
এই প্রাণে-ভরা মাটির ভিতরে
কত যুগ মোরা যেপেছি,
কত শরতের সোনার আলোকে
কত তৃণে দোঁহে কেঁপেছি॥॥
লক্ষ বরষ আগে যে প্রভাত
উঠেছিল এই ভুবনে
তাহার অরুণকিরণকণিকা
গাঁথ নি কি মোর জীবনে?
সে প্রভাতে কোন্খানে
জেগেছিনু কে বা জানে?
কী মুরতি-মাঝে ফুটালে আমারে
সেদিন লুকায়ে প্রাণে?
হে চির-পুরানো, চিরকাল মোরে
গড়িছ নূতন করিয়া।
চিরদিন তুমি সাথে ছিলে মোর,
রবে চিরদিন ধরিয়া।

তত্ত্ববিদ্যায় আমার কোনো অধিকার নাই।
দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদ কোনো তর্ক উঠিলে আমি
নিরুত্তর হইয়া থাকিব। আমি কেবল অনুভবের দিক
দিয়া বলিতেছি, আমার মধ্যে আমার অন্তর্দেবতার
একটি প্রকাশের আনন্দ রহিয়াছে--সেই আনন্দ সেই
প্রেম আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, আমার বুদ্ধিমন,
আমার নিকট প্রত্যক্ষ এই বিশ্বজগৎ, আমার অনাদি
অতীত ও অনন্ত ভবিষ্যৎ পরিপ্লুত করিয়া আছে। এ
লীলা তো আমি কিছুই বুঝি না, কিন্তু আমার মধ্যেই
নিয়ত এই এক প্রেমের লীলা। আমার চোখে যে আলো
ভালো লাগিতেছে, প্রভাত-সন্ধ্যার যে মেঘের ছটা
ভালো লাগিতেছে, তৃণতরুলতার যে শ্যামলতা ভালো
লাগিতেছে, প্রিয়জনের যে মুখচ্ছবি ভালো
লাগিতেছে--সমস্তই সেই প্রেমলীলার উদ্বেল
তরঙ্গমালা। তাহাতেই জীবনের সমস্ত সুখদুঃখের
সমস্ত আলো-অন্ধকারের ছায়া খেলিতেছে।
আমার মধ্যে এই যাহা গড়িয়া উঠিতেছে এবং যিনি
গড়িতেছেন, এই উভয়ের মধ্যে যে-একটি আনন্দের
সম্বন্ধ, যে-একটি নিত্যপ্রেমের বন্ধন আছে, তাহা
জীবনের সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়া উপলব্ধি করিলে
সুখদুঃখের মধ্যে একটি শান্তি আসে। যখন বুঝিতে
পারি, আমার প্রত্যেক আনন্দের উচ্ছ্বাস তিনি
আকর্ষণ করিয়া লইয়াছেন, আমার প্রত্যেক
দুঃখবেদনা তিনি নিজে গ্রহণ করিয়াছেন, তখন
জানি যে, কিছুই ব্যর্থ হয় নাই, সমস্তই একটা
জগদ্ব্যাপী সম্পূর্ণতার দিকে ধন্য হইয়া
উঠিতেছে।

এইখানে আমার একটি পুরাতন চিঠি হইতে একটা
জায়গা উদ্ধৃত করিয়া দিই--

ঠিক যাকে সাধারণে ধর্ম বলে, সেটা যে আমি
আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ়রূপে লাভ করতে
পেরেছি, তা বলতে পারি নে। কিন্তু মনের ভিতরে
ভিতরে ক্রমশ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হয়ে
উঠেছে, তা অনেক সময় অনুভব করতে পারি। বিশেষ
কোনো একটা নির্দিষ্ট মত নয়--একটা নিগূঢ় চেতনা,
একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়। আমি বেশ বুঝতে পারছি,
আমি ক্রমশ আপনার মধ্যে আপনার একটা সামঞ্জস্য
স্থাপন করতে পারব--আমার সুখদুঃখ, অন্তর-বাহির,
বিশ্বাস-আচরণ, সমস্তটা মিলিয়ে জীবনটাকে একটা
সমগ্রতা দিতে পারব। শাস্ত্রে যা লেখে তা সত্য
কি মিথ্যা বলতে পারি নে; কিন্তু সে-সমস্ত সত্য
অনেক সময় আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী, বস্তুত
আমার পক্ষে তার অস্তিত্ব নেই বললেই হয়। আমার
সমস্ত জীবন দিয়ে যে জিনিসটাকে সম্পূর্ণ আকরে
গড়ে তুলতে পারব সেই আমার চরমসত্য। জীবনের
সমস্ত সুখদুঃখকে যখন বিচ্ছিন্ন ক্ষণিকভাবে অনুভব
করি তখন আমদের ভিতরকার এই অনন্ত সৃজনরহস্য
ঠিক বুঝতে পারি নে--প্রত্যেক কথাটা বানান করে
পড়তে হলে যেমন সমস্ত পদটার অর্থ এবং ভাবের
ঐক্য বোঝা যায় না; কিন্তু নিজের ভিতরকার এই
সৃজনশক্তির অখণ্ড ঐক্যসূত্র যখন একবার অনুভব করা
যায় তখন এই সৃজ্যমান অনন্ত বিশ্বচরাচরের সঙ্গে
নিজের যোগ উপলব্ধি করি; বুঝতে পারি, যেমন
গ্রহনক্ষত্র-চন্দ্রসূর্য জ্বলতে জ্বলতে ঘুরতে ঘুরতে
চিরকাল ধরে তৈরি হয়ে উঠেছে, আমার ভিতরেও
তেমনি অনাদিকাল ধরে একটা সৃজন চলছে; আমার
সুখ-দুঃখ বাসনা-বেদনা তার মধ্যে আপনার আপনার
স্থান গ্রহণ করছে। এই থেকে কী হয়ে উঠবে জানি
নে, কারণ আমরা একটি ধূলিকণাকেও জানি নে।
কিন্তু নিজের প্রবহমান জীবনটাকে যখন নিজের
বাইরে অনন্ত দেশকালের সঙ্গে যোগ করে দেখি
তখন জীবনের সমস্ত দুঃখগুলিকেও একটা বৃহৎ
আনন্দসূত্রের মধ্যে গ্রথিত দেখতে পাই--আমি আছি,
আমি হচ্ছি, আমি চলছি, এইটেকে একটা বিরাট
ব্যাপার বলে বুঝতে পারি, আমি আছি এবং আমার
সঙ্গে সঙ্গেই আর-সমস্তই আছে, আমাকে ছেড়ে এই
অসীম জগতের একটি অণুপরমাণুও থাকতে পারে না,
আমার আত্মীয়দের সঙ্গে আমার যে যোগ, এই সুন্দর
শরৎপ্রভাতের সঙ্গে তার চেয়ে কিছুমাত্র কম
ঘনিষ্ঠ যোগ নয়-- সেইজন্যই এই জ্যোতির্ময় শূন্য
আমার অন্তরাত্মাকে তার নিজের মধ্যে এমন করে
পরিব্যাপ্ত করে নেয়। নইলে সে কি আমার মনকে
তিলমাত্র স্পর্শ করতে পারত? নইলে সে কি আমি
সুন্দর বলে অনুভব করতেম?... আমার সঙ্গে অনন্ত
জগৎ-প্রাণের যে চিরকালের নিগূঢ় সম্বন্ধ, সেই
সম্বন্ধের প্রত্যক্ষগম্য বিচিত্র ভাষা হচ্ছে
বর্ণগন্ধগীত। চতুর্দিকে এই ভাষার অবিশ্রাম
বিকাশ আমাদের মনকে লক্ষ্য-অলক্ষ্যভাবে
ক্রমাগতই আন্দোলিত করছে, কথাবার্তা দিনরাত্রিই
চলছে।

এই পত্রে আমার অন্তর্নিহিত যে সৃজনশক্তির কথা
লিখিয়াছি, যে শক্তি আমার জীবনের সমস্ত
সুখদুঃখকে সমস্ত ঘটনাকে ঐক্যদান তাৎপর্যদান
করিতেছে, আমার রূপরূপান্তর জন্মাজন্মান্তরকে
একসূত্রে গাঁথিতেছে, যাহার মধ্য দিয়া
বিশ্বচরাচরের মধ্যে ঐক্য অনুভব করিতেছি,
তাহাকেই "জীবনদেবতা' নাম দিয়া
লিখিয়াছিলাম--

ওহে অন্তরতম,
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম?
দুঃখসুখের লক্ষ ধারায়
পাত্র ভরিয়া দিয়েছি তোমায়,
নিঠুর পীড়নে নিঙাড়ি বক্ষ
দলিতদ্রাক্ষা-সম।
কত যে বরন, কত যে গন্ধ,
কত যে রাগিণী, কত যে ছন্দ,
গাঁথিয়া গাঁথিয়া করেছি বয়ন
বাসরশয়ন তব--
গলায়ে গলায়ে বাসনার সোনা
প্রতিদিন আমি করেছি রচনা
তোমার ক্ষণিক খেলার লাগিয়া
মূরতি নিত্যনব।

আশ্চর্য এই যে, আমি হইয়া উঠিতেছি, আমি প্রকাশ
পাইতেছি। আমার মধ্যে কী অনন্ত মাধুর্য আছে,
যেজন্য আমি অসীম ব্রহ্মাণ্ডের অগণ্য
সূর্যচন্দ্রগ্রহতারকার সমস্ত শক্তি দ্বারা লালিত
হইয়া,এই আলোকের মধ্যে আকাশের মধ্যে চোখ
মেলিয়া দাঁড়াইয়াছি--আমাকে কেহ ত্যাগ করিতেছে
না। মনে কেবল এই প্রশ্ন উঠে, আমি আমার এই
আশ্চর্য অস্তিত্বের অধিকার কেমন করিয়া রক্ষা
করিতেছি--আমার উপরে যে প্রেম, যে আনন্দ
অশ্রান্ত রহিয়াছে, যাহা না থাকিলে আমার
থাকিবার কোনো শক্তিই থাকিত না, আমি তাহাকে
কি কিছুই দিতেছি না?

আপনি বরিয়া লয়েছিলে মোরে
না জানি কিসের আশে,
লেগেছি কি ভালো, হে জীবননাথ,
আমার রজনী আমার প্রভাত
আমার নর্ম আমার কর্ম
তোমার বিজন বাসে?
বরষা শরতে বসন্তে শীতে
ধ্বনিয়াছে হিয়া যত সংগীতে
শুনেছ কি তাহা একেলা বসিয়া
আপন সিংহাসনে?
মানসকুসুম তুলি অঞ্চলে
গেঁথেছ কি মালা, পরেছ কি গলে,
আপনার মনে করেছ ভ্রমণ
মম যৌবনবনে?
কী দেখিছ বঁধু মরমমাঝারে
রাখিয়া নয়ন দুটি?
করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার
স্খলন পতন ত্রুটি?
পূজাহীন দিন, সেবাহীন রাত,
কত বার বার ফিরে গেছে নাথ,
অর্ঘ্যকুসুম ঝরে পড়ে গেছে
বিজন বিপিনে ফুটি।
যে সুরে বাঁধিলে এ বীণার তার
নামিয়া নামিয়া গেছে বার বার,
হে কবি, তোমার রচিত রাগিণী
আমি কি গাহিতে পারি?
তোমার কাননে সেচিবারে গিয়া
ঘুমায়ে পড়েছি ছায়ায় পড়িয়া,
সন্ধ্যাবেলায় নয়ন ভরিয়া
এনেছি অশ্রুবারি।

যদি এমন হয় যে, আমার বর্তমান জীবনের মধ্যে
এই  জীবনদেবতার সেবার সম্ভাবনা যতদূর ছিল
তাহা নিঃশেষ হইয়া গিয়া থাকে, যে আগুন তিনি
জ্বালাইয়া রাখিতে চান আমার বর্তমান জীবনের
ইন্ধন যদি ছাই হইয়া গিয়া আর তাহা রক্ষা
করিতে না পারে, তবে এ আগুন তিনি কি নিবিতে
দিবেন? এ অনাবশ্যক ছাই ফেলিয়া দিতে কতক্ষণ?
কিন্তু তাই বলিয়া এই জ্যোতিঃশিখা মরিবে কেন?
দেখা তো গিয়াছে, ইহা অবহেলার সামগ্রী নহে।
অন্তরে অন্তরে তো বুঝা গিয়াছে, ইহার উপরে
অনিমেষ আনন্দের দৃষ্টির অবসান নাই।

এখনি কি শেষ হয়েছে প্রাণেশ,
যা-কিছু আছিল মোর--
যত শোভা যত গান যত প্রাণ,
জাগরণ ঘুমঘোর?
শিথিল হয়েছে বাহুবন্ধন,
মদিরাবিহীন মম চুম্বন,
জীবনকুঞ্জে অভিসারনিশা
আজি কি হয়েছে ভোর?
ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা,
আনো নব রূপ, আনো নব শোভা,
নূতন করিয়া লহো আরবার
চিরপুরাতন মোরে।
নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়
নবীন জীবনডোরে।

নিজের জীবনের মধ্যে এই-যে আবির্ভাবকে অনুভব
করা গেছে--যে আবির্ভাব অতীতের মধ্য হইতে
অনাগতের মধ্যে প্রাণের পালের উপরে প্রেমের
হাওয়া লাগাইয়া আমাকে কাল-মহানদীর নূতন নূতন
ঘাটে বহন করিয়া লইয়া চলিয়াছেন, সেই
জীবনদেবতার কথা বলিলাম।

এই জীবনযাত্রার অবকাশকালে মাঝে মাঝে
শুভমুহূর্তে বিশ্বের দিকে যখন অনিমেষদৃষ্টি
মেলিয়া ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিয়াছি তখন আর
এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। নিজের সঙ্গে
বিশ্বপ্রকৃতির এক অবিচ্ছিন্ন যোগ, এক চিরপুরাতন
একাত্মকতা আমাকে একান্তভাবে আকর্ষণ করিয়াছে।
কতদিন নৌকায় বসিয়া সূর্যকরোদীপ্ত জলে স্থলে
আকাশে আমার অন্তরাত্মাকে নিঃশেষে বিকীর্ণ
করিয়া দিয়াছি; তখন মাটিকে আর মাটি বলিয়া
দূরে রাখি নাই, তখন জলের ধারা আমার অন্তরের
মধ্যে আনন্দগানে বহিয়া গেছে। তখনি এ কথা
বলিতে পারিয়াছি--

হই যদি মাটি, হই যদি জল,
হই যদি তৃণ, হই ফুলফল,
জীবসাথে যদি ফিরি ধরাতল
কিছুতেই নাই ভাবনা,
যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে
অন্তবিহীন আপনা।

তখনি এ কথা বলিয়াছি--

আমারে ফিরায়ে লহো, অয়ি বসুন্ধরে,
কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে
বিপুল অঞ্চলতলে। ওগো মা মৃণ্ময়ি,
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই,
দিগ্বিদিকে আপনাকে দিই বিস্তারিয়া
বসন্তের আনন্দের মতো।

এ কথা বলিতে কুণ্ঠিত হই নাই--

তোমার মৃত্তিকা-সনে
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশ্রান্তচরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ
সবিতৃমণ্ডল, অসংখ্য রজনীদিন
যুগযুগান্তর ধরি; আমার মাঝারে
উঠিয়াছ তৃণ তব, পুষ্প ভারে ভারে
ফুটিয়াছে, বর্ষণ করেছে তরুরাজি
পত্র ফুল ফল গন্ধরেণু।

আমার স্বাতন্ত্র্যগর্ব নাই--বিশ্বের সহিত আমি
আমার কোনো বিচ্ছেদ স্বীকার করি না।

মানব-আত্মার দম্ভ আর নাহি মোর
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে;
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর।

আশা করি, পাঠকেরা ইহা হইতে এ কথা বুঝিবেন,
আমি আত্মাকে বিশ্বপ্রকৃতিকে বিশ্বেশ্বরকে
স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র কোঠায় খণ্ড খণ্ড করিয়া রাখিয়া
আমার ভক্তিকে বিভক্ত করি নাই।

আমি, কি আত্মার মধ্যে কি বিশ্বের মধ্যে,
বিস্ময়ের অন্ত দেখি না। আমি জড় নাম দিয়া,
সসীম নাম দিয়া, কোনো জিনিসকে এক পাশে
ঠেলিয়া রাখিতে পারি নাই। এই সীমার মধ্যেই,
এই প্রত্যক্ষের মধ্যেই, অনন্তের যে প্রকাশ তাহাই
আমার কাছে অসীম বিস্ময়াবহ। আমি এই জলস্থল
তরুলতা পশুপক্ষী চন্দ্রসূর্য দিনরাত্রির মাঝখান
দিয়া চোখ মেলিয়া চলিয়াছি, ইহা আশ্চর্য। এই
জগৎ তাহার অণুতে পরমাণুতে, তাহার প্রত্যেক
ধূলিকণায় আশ্চর্য। আমাদের পিতামহগণ যে
অগ্নিবায়ু-সূর্যচন্দ্র-মেঘবিদ্যুৎকে দিব্যদৃষ্টি
দ্বারা দেখিয়াছিলেন, তাঁহারা যে সমস্তজীবন এই
অচিন্তনীয় বিশ্বমহিমার মধ্য দিয়া সজীব ভক্তি ও
বিস্ময় লইয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, বিশ্বের সমস্ত
স্পর্শই তাঁহাদের অন্তরবীণায় নব নব স্তবসংগীত
ঝংকৃত করিয়া তুলিয়াছিল--ইহা আমার অন্তঃকরণকে
স্পর্শ করে। সূর্যকে যাহারা অগ্নিপিণ্ড বলিয়া
উড়াইয়া দিতে চায় তাহারা যেন জানে যে, অগ্নি
কাহাকে বলে। পৃথিবীকে যাহারা "জলরেখাবলয়িত'
মাটির গোলা বলিয়া স্থির করিয়াছে তাহারা যেন
মনে করে যে, জলকে জল বলিলেই সমস্ত জল বোঝা
গেল এবং মাটিকে মাটি বলিলেই সে মাটি হইয়া
যায়!

প্রকৃতিসম্বন্ধে আমার পুরাতন তিনটি পত্র হইতে
তিন জায়গা তুলিয়া দিব--

...এমন সুন্দর দিনরাত্রিগুলি আমার জীবন থেকে
প্রতিদিন চলে যাচ্ছে--এর সমস্তটা গ্রহণ করতে
পারছি নে! এই সমস্ত রঙ, এই আলো এবং ছায়া, এই
আকাশব্যাপী নিঃশব্দ সমারোহ, এই দ্যুলোকভূলোকের
মাঝখানের সমস্ত-শূন্য-পরিপূর্ণ-করা শান্তি এবং
সৌন্দর্য--এর জন্যে কি কম আয়োজন চলছে! কতবড়ো
উৎসবের ক্ষেত্রটা! এতবড়ো আশ্চর্য কাণ্ডটা
প্রতিদিন আমাদের বাইরে হয়ে যাচ্ছে, আর
আমাদের ভিতরে ভালো করে তার সাড়াই পাওয়া
যায় না! জগৎ থেকে এতই তফাতে আমরা বাস করি!
লক্ষ লক্ষ যোজন দূর থেকে লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে
অনন্ত অন্ধকারের পথে যাত্রা করে একটি তারার
আলো এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়, আর আমাদের অন্তরে
এসে প্রবেশ করতে পারে না! মনটা যেন আরো
শতলক্ষ যোজন দূরে! রঙীন সকাল এবং রঙিন
সন্ধ্যাগুলি দিগ্বধূদের ছিন্ন কণ্ঠহার হতে এক-
একটি মানিকের মতো সমুদ্রের জলে খসে খসে পড়ে
যাচ্ছে, আমাদের মনের মধ্যে একটাও এসে পড়ে
না! ...যে পৃথিবীতে এসে পড়েছি, এখানকার
মানুষগুলি সব অদ্ভূত জীব। এরা কেবলই দিনরাত্রি
নিয়ম এবং দেয়াল গাঁথছে--পাছে দুটো চোখে কিছু
দেখতে পায় এইজন্যে পর্দা টাঙিয়ে দিচ্ছে--
বাস্তবিক পৃথিবীর জীবগুলো ভারি অদ্ভূত। এরা যে
ফুলের গাছে এক-একটি ঘেরাটোপ পরিয়ে রাখে নি,
চাঁদের নীচে চাঁদোয়া খাটায় নি, সেই আশ্চর্য! এই
স্বেচ্ছা-অন্ধগুলো বন্ধ পালকির মধ্যে চড়ে পৃথিবীর
ভিতর দিয়ে কী দেখে চলে যাচ্ছে!

...এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে
ছিলেম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো
এসে পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল
অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধ
উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূরদূরান্তর
দেশদেশান্তরের জলস্থল ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল
আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতেম,
তখন শরৎসূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে-একটি
আনন্দরস, যে-একটি জীবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত
অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ড বৃহৎ-ভাবে
সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে
পড়ে। আমার এই-যে মনের ভাব, এ যেন এই
প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথ
আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার
প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে
শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত
হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে,
এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের
আবেগে থর থর করে কাঁপছে।

...এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক
জন্মকার ভালোবাসার লোকের মতো আমার কাছে
চিরকাল নতুন॥॥আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ
পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা
তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন--
তখন আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক
প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে
উঠেছিলাম। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না,
বৃহৎ সমুদ্র দিনরাত্রি দুলছে এবং অবোধ মাতার
মতো আপনার নবজাত ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে
উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেলছে। তখন
আমি এই পৃথিবীতে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম
সূর্যালোক পান করেছিলেম--নবশিশুর মতো একটা
অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আন্দোলিত হয়ে
উঠেছিলেম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত
শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান
করেছিলেম। একটা মূঢ় আনন্দে আমার ফুল ফুটত এবং
নবপল্লব উদ্গত হত। যখন ঘনঘটা করে বর্ষার মেঘ
উঠত তখন তার ঘনশ্যামচ্ছটায় আমার সমস্ত পল্লবকে
একটা পরিচিত করতলের মতো স্পর্শ করত। তার
পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে আমি
জন্মেছি। আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি করে বসলেই
আমাদের বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে
পড়ে। আমার বসুন্ধরা এখন একখানি রৌদ্রপীতহিরণ্য
অঞ্চল প'রে ঐ নদীতীরের শস্যক্ষেত্রে বসে আছেন--
আমি তাঁর পায়ের কাছে, কোলের কাছে গিয়ে লুটিয়ে
পড়ছি। অনেক ছেলের মা যেমন অর্ধমনস্ক অথচ
নিশ্চল সহিষ্ণুভাবে আপন শিশুদের আনাগোনার
প্রতি তেমন দৃক্পাত করেন না, তেমনি আমার
পৃথিবী এই দুপুরবেলায় ঐ আকাশপ্রান্তের দিকে
চেয়ে বহু আদিমকালের কথা ভাবছেন--আমার দিকে
তেমন লক্ষ করছেন না, আর আমি কেবল অবিশ্রাম
বকেই যাচ্ছি।

প্রকৃতি তাহার রূপরস বর্ণগন্ধ লইয়া, মানুষ তাহার
বুদ্ধিমন তাহার স্নেহপ্রেম লইয়া, আমাকে মুগ্ধ
করিয়াছে--সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না,
সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না। তাহা আমাকে
বদ্ধ করিতেছে না, তাহা আমাকে মুক্তই করিতেছে;
তাহা আমাকে আমার বাহিরেই ব্যাপ্ত করিতেছে।
নৌকার গুণ নৌকাকে বাঁধিয়া রাখে নাই, নৌকাকে
টানিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। জগতের সমস্ত
আকর্ষণপাশ আমাদিগকে তেমনি অগ্রসর করিতেছে,
কেহ-বা দ্রুত চলিতেছে বলিয়া সে আপন
গতিসম্বন্ধে সচেতন, কেহ-বা মন্দগমনে চলিতেছে
বলিয়া মনে করিতেছে বুঝি-বা সে এক জায়গায়
বাঁধাই পড়িয়া আছে। কিন্তু সকলকেই চলিতে
হইতেছে--সকলই এই জগৎসংসারের নিরন্তর টানে
প্রতিদিনই ন্যূনাধিক পরিমাণে আপনার দিক হইতে
ব্রহ্মর দিকে ব্যাপ্ত হইতেছে। আমরা যেমনই মনে
করি, আমাদের ভাই, আমাদের প্রিয়, আমাদের পুত্র,
আমাদিগকে একটি জায়গায় বাঁধিয়া রাখে নাই; যে
জিনিসটাকে সন্ধান করিতেছি, দীপালোক
কেবলমাত্র সেই জিনিসটাকে প্রকাশ করে তাহা
নহে, সমস্ত ঘরকে আলোকিত করে--প্রেম প্রেমের
বিষয়কে অতিক্রম করিয়াও ব্যাপ্ত হয়। জগতের
সৌন্দর্যের মধ্য দিয়া, প্রিয়জনের মাধুর্যের মধ্য
দিয়া ভগবানই আমাদিগকে টানিতেছেন--আর-
কাহারো টানিবার ক্ষমতাই নাই। পৃথিবীর প্রেমের
মধ্য দিয়াই সেই ভূমানন্দের পরিচয় পাওয়া,
জগতের এই রূপের মধ্যেই সেই অপরূপকে সাক্ষাৎ
প্রত্যক্ষ করা, ইহাকেই তো আমি মুক্তির সাধনা
বলি। জগতের মধ্যে আমি মুগ্ধ, সেই মোহেই আমার
মুক্তিরসের আস্বাদন--

বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতো
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দিরমাঝে। ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার।
যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তারি মাঝখানে।
মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।

আমি বালকবয়সে "প্রকৃতির প্রতিশোধ'
লিখিয়াছিলাম-- তখন আমি নিজে ভালো করিয়া
বুঝিয়াছিলাম কি না জানি না--কিন্তু তাহাতে এই
কথা ছিল যে, এই বিশ্বকে গ্রহণ করিয়া, এই
সংসারকে বিশ্বাস করিয়া, এই প্রত্যক্ষকে শ্রদ্ধা
করিয়া আমরা যথার্থভাবে অনন্তকে উপলব্ধি
করিতে পারি। যে জাহাজে অনন্তকোটি লোক যাত্রা
করিয়া বাহির হইয়াছে তাহা হইতে লাফ দিয়া
পড়িয়া সাঁতারের জোরে সমুদ্র পার হইবার চেষ্টা
সফল হইবার নহে।

হে বিশ্ব, হে মহাতরী, চলেছ কোথায়?
আমারে তুলিয়া লও তোমার আশ্রয়ে।
একা আমি সাঁতারিয়া পারিব না যেতে।
কোটি কোটি যাত্রী ওই যেতেছে চলিয়া--
আমিও চলিতে চাই উহাদেরি সাথে।
যে পথে তপন শশী আলো ধরে আছে
সে পথ করিয়া তুচ্ছ, সে আলো ত্যজিয়া
আপনারি ক্ষুদ্র এই খদ্যোত-আলোকে
কেন অন্ধকারে মরি পথ খুঁজে খুঁজে।
পাখি যবে উড়ে যায় আকাশের পানে
মনে করে এনু বুঝি পৃথিবী ত্যজিয়া;
যত ওড়ে, যত ওড়ে, যত ঊর্ধ্বে যায়,
কিছুতে পৃথিবী তবু পারে না ছাড়িতে--
অবশেষে শ্রান্তদেহে নীড়ে ফিরে আসে।

পরিণত বয়সে যখন "মালিনী' নাট্য লিখিয়াছিলাম,
তখনো এইরূপ  দূর হইতে নিকটে, অনির্দিষ্ট হইতে
নির্দিষ্টে, কল্পনা হইতে প্রত্যক্ষের মধ্যেই
ধর্মকে উপলব্ধি করিবার কথা বলিয়াছি--

বুঝিলাম ধর্ম দেয় স্নেহ মাতারূপে,
পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুন; দাতারূপে
করে দান, দীনরূপে করে তা গ্রহণ;
শিষ্যরূপে করে ভক্তি, গুরুরূপে করে
আশীর্বাদ; প্রিয়া হয়ে পাষাণ-অন্তরে
প্রেম-উৎস লয় টানি, অনুরক্ত হয়ে
করে সর্বত্যাগ। ধর্ম বিশ্বলোকালয়ে
ফেলিয়াছে চিত্তজাল, নিখিল ভুবন
টানিতেছে প্রেমক্রোড়ে--সে মহাবন্ধন
ভরেছে অন্তর মোর আনন্দবেদনে।

নিজের সম্বন্ধে আমার যেটুকু বক্তব্য ছিল, তাহা
শেষ হইয়া আসিল, এইবার শেষ কথাটা বলিয়া
উপসংহার করিব--

মর্তবাসীদের তুমি যা দিয়েছ, প্রভু,
মর্তের সকল আশা মিটাইয়া তবু
রিক্ত তাহা নাহি হয়। তার সর্বশেষ
আপনি খুঁজিয়া ফিরে তোমারি উদ্দেশ।
নদী ধায় নিত্যকাজে; সর্বকর্ম সারি
অন্তহীন ধারা তার চরণে তোমারি
নিত্য জলাঞ্জলিরূপে ঝরে অনিবার
কুসুম আপন গন্ধে সমস্ত সংসার
সম্পূর্ণ করিয়া তবু সম্পূর্ণ না হয়--
তোমারি পূজায় তার শেষ পরিচয়।
সংসারে বঞ্চিত করি তব পূজা নহে।
কবি আপনার গানে যত কথা কহে
নানা জনে লহে তার নানা অর্থ টানি,
তোমাপানে ধায় তার শেষ অর্থখানি!

আমার কাব্য ও জীবন সম্বন্ধে মূলকথাটা কতক
কবিতা উদ্ধৃত করিয়া, কতক ব্যাখ্যা দ্বারা
বোঝাইবার চেষ্টা করা গেল। বোঝাইতে পারিলাম
কি না জানি না--কারণ, বোঝানো-কাজটা সম্পূর্ণ
আমার নিজের হাতে নাই--যিনি বুঝিবেন তাঁহার
উপরেও অনেকটা নির্ভর করিবে। আশঙ্কা আছে, অনেক
পাঠক বলিবেন, কাব্যও হেঁয়ালি রহিয়া গেল,
জীবনটাও তথৈবচ। বিশ্বশক্তি যদি আমার কল্পনায়
আমার জীবনে এমন বাণীরূপে উচ্চারিত হইয়া
থাকেন যাহা অন্যের পক্ষে দুর্বোধ তবে আমার
কাব্য আমার জীবন পৃথিবীর কাহারো কোনো কাজে
লাগিবে না--সে আমারই ক্ষতি, আমারই ব্যর্থতা।
সেজন্য আমাকে গালি দিয়া কোনো লাভ নাই, আমার
পক্ষে তাহার সংশোধন অসম্ভব--
আমার অন্য কোনো গতি ছিল না।

বিশ্বজগৎ যখন মানবের হৃদয়ের মধ্য দিয়া,
জীবনের মধ্য দিয়া, মানবভাষায় ব্যক্ত হইয়া উঠে
তখন তাহা কেবলমাত্র প্রতিধ্বনি-প্রতিচ্ছায়ার
মতো দেখা দিলে বিশেষ কিছু লাভ নাই।
কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়দ্বারা আমরা জগতের যে
পরিচয় পাইতেছি তাহা জগৎপরিচয়ের কেবল
সামান্য একাংশমাত্র--সেই পরিচয়কে আমরা
ভাবুকদিগের, কবিদিগের, মন্ত্রদষ্টা ঋষিদিগের
চিত্তের ভিতর দিয়া কালে কালে নবতররূপে
গভীরতররূপে সম্পূর্ণ করিয়া লইতেছি। কোন্
গীতিকাব্যরচয়িতার কোন্ কবিতা ভালো, কোন্টা
মাঝারি, তাহাই খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখানো
সমালোচকের কাজ নহে। তাঁহার সমস্ত কাব্যের
ভিতর দিয়া বিশ্ব কোন্ বাণীরূপে আপনাকে প্রকাশ
করিতেছে তাহাই বুঝিবার যোগ্য। কবিকে উপলক্ষ
করিয়া বীণাপাণি বাণী, বিশ্বজগতের
প্রকাশশক্তি, আপনাকে কোন্ আকারে ব্যক্ত
করিয়াছেন তাহাই দেখিবার বিষয়।

জগতের মধ্যে যাহা অনির্বচনীয় তাহা কবির
হৃদয়দ্বারে প্রত্যহ বারংবার আঘাত করিয়াছে, সেই
অনির্বচনীয় যদি কবির কাব্যে বচন লাভ করিয়া
থাকে--জগতের মধ্যে যাহা অপরূপ তাহা কবির
মুখের দিকে প্রত্যহ আসিয়া তাকাইয়াছে, সেই
অপরূপ যদি কবির কাব্যে রূপলাভ করিয়া থাকে--
যাহা চোখের সম্মুখে মূর্তিরূপে প্রকাশ পাইতেছে
তাহা যদি কবির কাব্যে ভাবরূপে আপনাকে ব্যাপ্ত
করিয়া থাকে--যাহা অশরীরভাবরূপে নিরাশ্রয়
হইয়া ফিরে তাহাই যদি কবির কাব্যে মূর্তি
পরিগ্রহ করিয়া সম্পূর্ণতালাভ করিয়া থাকে--তবেই
কাব্য সফল হইয়াছে এবং সেই সফল কাব্যই কবির
প্রকৃত জীবনী। সেই জীবনীর বিষয়ীভূত ব্যক্তিটিকে
কাব্যরচয়িতার জীবনের সাধারণ ঘটনাবলীর মধ্যে
ধরিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা।

বাহির হইতে দেখো না এমন করে,
আমায় দেখো না বাহিরে।
আমায় পাবে না আমার দুখে ও সুখে,
আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে,
আমায় দেখিতে পাবে না আমার মুখে,
কবিরে খুঁজিছ যেথায় সেথা সে নাহি রে॥॥
যে আমি স্বপনমুরতি গোপনচারি,
যে আমি আমারে বুঝিতে বোঝাতে নারি,
আপন গানের কাছেতে আপনি হারি,
সেই আমি কবি, এসেছ কাহারে ধরিতে?
মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে,
ভূমিতে লুতায় প্রতি নিমেষের ভরে,
যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে,
কবিরে খুঁজিছ তাহারি জীবনচরিতে?
-
১৩১১
-
পর্যায় - প্রবন্ধ