শেষের কবিতা (পর্ব-৪)
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
সভাটাকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে মোটরে করে অমিত যখন বাড়ি
আসছিল, সিসি তাকে বললে, "একখানা আস্ত নিবারণ
চক্রবর্তী তুমি নিশ্চয় আগে থাকতে গড়ে তুলে পকেটে করে
নিয়ে এসেছ, কেবলমাত্র ভালোমানুষকে বোকা বানাবার
জন্যে।"
অমিত বললে, "অনাগতকে যে মানুষ এগিয়ে নিয়ে আসে তাকেই
বলে অনাগত-বিধাতা। আমি তাই। নিবারণ চক্রবর্তী আজ
মর্তে এসে পড়ল, কেউ তাকে আর ঠেকাতে পারবে না।"
সিসি অমিতকে নিয়ে মনে মনে খুব একটা গর্ব বোধ করে। সে
বললে, "আচ্ছা অমিত, তুমি কি সকালবেলা উঠেই সেদিনকার
মতো তোমার যত শানিয়ে-বলা কথা বানিয়ে রেখে দাও?"
অমিত বললে, "সম্ভবপরের জন্যে সব সময়েই প্রস্তুত
থাকাই সভ্যতা; বর্বরতা পৃথিবীতে সকল বিষয়েই অপ্রস্তুত।
এ কথাটাও আমার নোট-বইয়ে লেখা আছে।"
"কিন্তু তোমার নিজের মত বলে কোনো পদার্থই নেই;
যখন যেটা বেশ ভালো শোনায় সেইটেই তুমি বলে বস।"
"আমার মনটা আয়না, নিজের বাঁধা মতগুলো দিয়েই
চিরদিনের মতো যদি তাকে আগাগোড়া লেপে রেখে দিতুম তা
হলে তার উপরে প্রত্যেক চলতি মুহূর্তের প্রতিবিম্ব পড়ত
না।"
সিসি বললে, "অমি, প্রতিবিম্ব নিয়েই তোমার জীবন
কাটবে।"
অমিত বেছে বেছে শিলঙ পাহাড়ে গেল। তার কারণ, সেখানে
ওর দলের লোক কেউ যায় না। আরো একটা কারণ, ওখানে
কন্যাদায়ের বন্যা তেমন প্রবল নয়। অমিতর হৃদয়টার 'পরে
যে দেবতা সর্বদা শরসন্ধান করে ফেরেন তাঁর আনাগোনা
ফ্যাশানেবল পাড়ায়। দেশের পাহাড়-পর্বতে যত বিলাসী বসতি
আছে তার মধ্যে শিলঙে এদের মহলে তাঁর টার্গেট-প্র
৻াক্টিসের জায়গা সব চেয়ে সংকীর্ণ। বোনেরা মাথা ঝাঁকানি
দিয়ে বললে, "যেতে হয় একলা যাও, আমরা যাচ্ছি নে।"
বাঁ হাতে হাল কায়দার বেঁটে ছাতা, ডান হাতে টেনিস ব্যাট,
গায়ে নকল পারসিক শালের ক্লোক পরে বোনরা গেল চলে
দার্জিলিঙে। বিমি বোস আগেভাগেই সেখানে গিয়েছে। যখন
ভাইকে বাদ দিয়ে বোনদের সমাগম হল তখন সে চার দিক
চেয়ে আবিষ্কার করলে দার্জিলিঙে জনতা আছে, মানুষ নেই।
অমিত সবাইকে বলে গিয়েছিল, সে শিলঙে যাচ্ছে নির্জনতা
ভোগের জন্যে-- দুদিন না যেতেই বুঝলে, জনতা না থাকলে
নির্জনতার স্বাদ মরে যায়। ক্যামেরা হাতে দৃশ্য দেখে
বেড়াবার শখ অমিতর নেই। সেই বলে, আমি টুরিস্ট না, মন
দিয়ে চেখে খাবার ধাত আমার, চোখ দিয়ে গিলে খাবার ধাত
একেবারেই নয়।
কিছুদিন ওর কাটল পাহাড়ের ঢালুতে দেওদার গাছের ছায়ায় বই
পড়ে পড়ে। গল্পের বই ছুঁলে না, কেননা, ছুটিতে গল্পের বই
পড়া সাধারণের দস্তুর। ও পড়তে লাগল সুনীতি চাটুজ্যের
বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব, লেখকের সঙ্গে মনান্তর ঘটবে এই
একান্ত আশা মনে নিয়ে। এখানকার পাহাড় পর্বত অরণ্য ওর
শব্দতত্ত্ব এবং আলস্য জড়তার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ সুন্দর
ঠেকে, কিন্তু সেটা মনের মধ্যে পুরোপুরি ঘনিয়ে ওঠে না;
যেন কোনো রাগিণীর একঘেয়ে আলাপের মতো-- ধুয়ো নেই,
তাল নেই, সম নেই। অর্থাৎ, ওর মধ্যে বিস্তর আছে কিন্তু
এক নেই-- তাই এলানো জিনিস ছড়িয়ে পড়ে, জমা হয় না।
অমিতর আপন নিখিলের মাঝখানে একের অভাবে ও যে
কেবলই চঞ্চলভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে সে দুঃখ ওর
এখানেও যেমন, শহরেও তেমনি। কিন্তু শহরে সেই
চাঞ্চল্যটাকে সে নানাপ্রকারে ক্ষয় করে ফেলে, এখানে
চাঞ্চল্যটাই স্থির হয়ে জমে জমে ওঠে। ঝরনা বাধা পেয়ে
যেমন সরোবর হয়ে দাঁড়ায়। তাই ও যখন ভাবছে, পালাই
পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে সিলেট-শিলচরের ভিতর
দিয়ে যেখানে খুশি, এমন সময় আষাঢ় এল পাহাড়ে পাহাড়ে বনে
বনে তার সজল ঘনচ্ছায়ার চাদর লুটিয়ে। খবর পাওয়া গেল,
চেরাপুঞ্জির গিরিশৃঙ্গ নববর্ষার মেঘদলের পুঞ্জিত
আক্রমণ আপন বুক দিয়ে ঠেকিয়েছে; এইবার ঘন বর্ষণে
গিরিনির্ঝরিণীগুলোকে খেপিয়ে কূলছাড়া করবে। স্থির করলে,
এই সময়টাতে কিছুদিনের জন্যে চেরাপুঞ্জির ডাকবাংলায়
এমন মেঘদূত জমিয়ে তুলবে যার অলক্ষ্য অলকার নায়িকা
অশরীরী বিদ্যুতের মতো, চিত্ত-আকাশে ক্ষণে ক্ষণে চমক
দেয়-- নাম লেখে না, ঠিকানা রেখে যায় না।
সেদিন সে পরল হাইলাণ্ডারি মোটা কম্বলের মোজা, পুরু
সুকতলাওয়ালা মজবুত চামড়ার জুতো, খাকি নরফোক কোর্তা,
হাঁটু পর্যন্ত হ্রস্ব অধোবাস, মাথায় সোলা টুপি। অবনী
ঠাকুরের আঁকা যক্ষের মতো দেখতে হল না-- মনে হতে
পারত রাস্তা তদারক করতে বেরিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট্
এঞ্জিনিয়ার। কিন্তু পকেটে ছিল গোটা পাঁচ-সাত পাতলা
এডিশনের নানা ভাষার কাব্যের বই।
-
Saturday, July 2, 2016
শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (পর্ব-৪)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.