Friday, July 1, 2016

শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (পর্ব-৩)

শেষের কবিতা (পর্ব-৩)
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
সভাপতি উঠে বললে, "কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে
কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না
যে, পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব
অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরোলে বলব না, "আনো
ফজলিতর আম।' বলব, "নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে
আতা নিয়ে এসো তো হে।' ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে
রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি, সে শাঁসের
মেয়াদ। কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর
নেই।... রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে,
বুড়ো ওঅর্ড্স্ওঅর্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি
অন্যায়রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে
থেকে ফরাশ পাঠায়, তবু লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও চৌকির
হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না
পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা।
পরবর্তী যিনি আসবেন তিনিও তাল ঠুকেই গর্জাতে গর্জাতে
আসবেন যে, তাঁর রাজত্বের অবসান নেই। অমরাবতী বাঁধা
থাকবে মর্তে তাঁরই দরজায়। কিছুকাল ভক্তরা দেবে
মাল্যচন্দন, খাওয়াবে পেট ভরিয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত
করবে, তার পরে আসবে তাঁকে বলি দেবার পুণ্য দিন--
ভক্তিবন্ধন থেকে ভক্তদের পরিত্রাণের শুভ লগ্ন।
আফ্রিকায় চতুষ্পদ দেবতার পুজোর প্রণালী এইরকমই।
দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী চতুর্দশপদী দেবতাদের পুজোও
এই নিয়মে। পূজা জিনিসটাকে একঘেয়ে করে তোলার মতো
অপবিত্র অধার্মিকতা আর কিছু হতে পারে না।... ভালো
লাগার এভোল্যুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা
পাঁচ বছর পরেও যদি একই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা
হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে, সে মরে গেছে।
একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে,
সেণ্টিমেণ্টাল আত্মীয়েরা তার অন্ত্যেষ্টি-সৎকার করতে
বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে
চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে। রবি ঠাকুরের দলের এই অবৈধ
ষড়যন্ত্র আমি পাব্লিকের কাছে প্রকাশ করব বলে
প্রতিজ্ঞা করেছি।"

আমাদের মণিভূষণ চশমার ঝলক লাগিয়ে প্রশ্ন করলে,
"সাহিত্য থেকে লয়ালটি উঠিয়ে দিতে চান?"

"একেবারেই। এখন থেকে কবি-প্রেসিডেণ্টের দ্রুতনিঃশেষিত
যুগ। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে,
তাঁর রচনারেখা তাঁরই হাতের অক্ষরের মতো-- গোল বা
তরঙ্গরেখা, গোলাপ বা নারীর মুখ বা চাঁদের ধরনে। ওটা
প্রিমিটিভ; প্রকৃতির হাতের অক্ষরের মক্শো-করা। নতুন
প্রেসিডেণ্টের কাছে চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা--
তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো। ফুলের
মতো নয়, বিদ্যুতের রেখার মতো। ন্যুর৻ালজিয়ার ব্যথার
মতো। খোঁচাওয়ালা কোণওয়ালা গথিক গির্জের ছাঁদে,
মন্দিরের মণ্ডপের ছাঁদে নয়। এমন-কি, যদি চটকল পাটকল
অথবা সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিঙের আদলে হয়, ক্ষতি নেই।...
এখন থেকে ফেলে দাও মন-ভোলাবার ছলাকলা ছন্দোবন্ধ,
মন কেড়ে নিতে হবে, যেমন করে রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে
গিয়েছিল। মন যদি কাঁদতে কাঁদতে আপত্তি করতে করতে যায়
তবুও তাকে যেতেই হবে-- অতিবৃদ্ধ জটায়ুটা বারণ করতে
আসবে, তাই করতে গিয়েই তার হবে মরণ। তার পরে কিছুদিন
যেতেই কিষ্কিন্ধ্যা জেগে উঠবে, কোন্ হনুমান হঠাৎ লাফিয়ে
পড়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে মনটাকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে
আসবার ব্যবস্থা করবে। তখন আবার হবে টেনিসনের সঙ্গে
পুনর্মিলন, বায়রণের গলা জড়িয়ে করব অশ্রুবর্ষণ;
ডিকেন্স্কে বলব, মাপ করো, মোহ থেকে আরোগ্যলাভের
জন্যে তোমাকে গাল দিয়েছি।... মোগল বাদশাদের কাল
থেকে আজ পর্যন্ত দেশের যত মুগ্ধ মিস্ত্রি মিলে যদি
যেখানে-সেখানে ভারত জুড়ে কেবলই গম্বুজওয়ালা পাথরের
বুদ্বুদ্ বানিয়ে চলত তা হলে ভদ্রলোক মাত্রই যেদিন বিশ
বছর বয়স পেরোত সেইদিনই বানপ্রস্থ নিতে দেরি করত না।
তাজমহলকে ভালো-লাগাবার জন্যেই তাজমহলের নেশা
ছুটিয়ে দেওয়া দরকার।"

(এইখানে বলে রাখা দরকার,কথার তোড় সামলাতে না পেরে
সভার রিপোর্টারের মাথা ঘুরে গিয়েছিল, সে যা রিপোর্ট
লিখেছিল সেটা অমিতর বক্তৃতার চেয়েও অবোধ্য হয়ে
উঠেছিল। তারই থেকে যে-কটা টুকরো উদ্ধার করতে পারলুম
তাই আমরা উপরে সাজিয়ে দিয়েছি।)

তাজমহলের পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের ভক্ত
আরক্তমুখে বলে উঠল, "ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই
ভালো।"

অমিত বললে, "ঠিক তার উলটো। বিধাতার রাজ্যে ভালো
জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের
ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।... যে-সব কবি ষাট-সত্তর পর্যন্ত
বাঁচতে একটুও লজ্জা করে না তারা নিজেকে শাস্তি দেয়
নিজেকে সস্তা করে দিয়ে। শেষকালটায় অনুকরণের দল চারি
দিকে ব্যূহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভ্যাংচাতে থাকে। তাদের
লেখার চরিত্র বিগড়ে যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি শুরু করে
হয়ে পড়ে পূর্বের লেখার রিসীভস্ অফ স্টোল্ন্ প্রপার্টি।
সে স্থলে লোকহিতের খাতিরে পাঠকদের কর্তব্য হচ্ছে
কিছুতেই এই-সব অতিপ্রবীণ কবিদের বাঁচতে না দেওয়া--
শারীরিক বাঁচার কথা বলছি নে, কাব্যিক বাঁচা। এদের পরমায়ু
নিয়ে বেঁচে থাক্ প্রবীণ অধ্যাপক, প্রবীণ পোলিটিশন,
প্রবীণ সমালোচক।"

সেদিনকার বক্তা বলে উঠল, "জানতে পারি কি, কাকে আপনি
প্রেসিডেণ্ট করতে চান? তার নাম করুন।"

অমিত ফস্ করে বললে, "নিবারণ চক্রবর্তী।"

সভার নানা চৌকি থেকে বিস্মিত রব উঠল-- "নিবারণ
চক্রবর্তী? সে লোকটা কে।"

"আজকের দিনে এই-যে প্রশ্নের অঙ্কুর মাত্র, আগামী দিনে
এর থেকে উত্তরের বনস্পতি জেগে উঠবে।"

"ইতিমধ্যে আমরা একটা নমুনা চাই।"

"তবে শুনুন।" বলে পকেট থেকে একটা সরু লম্বা ক্যাম্বিসে-
বাঁধা খাতা বের করে তার থেকে পড়ে গেল--
-
আনিলাম
অপরিচিতের নাম
ধরণীতে,
পরিচিত জনতার সরণীতে।
আমি আগন্তুক,
আমি জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক।
খোলো দ্বার,
বার্তা আনিয়াছি বিধাতার।
মহাকালেশ্বর
পাঠায়েছে দুর্লক্ষ্য অক্ষর,
বল্ দুঃসাহসী কে কে
মৃত্যু পণ রেখে
দিবি তার দুরূহ উত্তর।

শুনিবে না।
মূঢ়তার সেনা
করে পথরোধ।
ব্যর্থ ক্রোধ
হুংকারিয়া পড়ে বুকে,
তরঙ্গের নিষ্ফলতা
নিত্য যথা
মরে মাথা ঠুকে
শৈলতট-'পরে
আত্মঘাতী দম্ভভরে।

পুষ্পমাল্য নাহি মোর, রিক্ত বক্ষতল,
নাহি বর্ম অঙ্গদ কুণ্ডল।
শূন্য এ ললাটপট্টে লিখা।
গূঢ় জয়টিকা।
ছিন্ন কন্থা দরিদ্রের বেশ।
করিব নিঃশেষ
তোমার ভাণ্ডার।
খোলো খোলো দ্বার।
অকস্মাৎ
বাড়ায়েছি হাত,
যা দিবার দাও অচিরাৎ।
বক্ষ তব কেঁপে উঠে, কম্পিত অর্গল,
পৃথ্বী টলমল।

ভয়ে আর্ত উঠিছে চীৎকারি
দিগন্ত বিদারি,
"ফিরে যা এখনি,
রে দুর্দান্ত দুরন্ত ভিখারি,
তোর কণ্ঠধ্বনি
ঘুরি ঘুরি
নিশীথনিদ্রার বক্ষে হানে তীব্র ছুরি।"

অস্ত্র আনো।
ঝঞ্ঝনিয়া আমার পঞ্জরে হানো।
মৃত্যুরে মারুক মৃত্যু, অক্ষয় এ প্রাণ
করি যাব দান।
শৃঙ্খল জড়াও তবে,
বাঁধো মোরে, খণ্ড খণ্ড হবে,
মুহূর্তে চকিতে,
মুক্তি তব আমারি মুক্তিতে।
শাস্ত্র আনো।
হানো মোরে, হানো।
পণ্ডিতে পণ্ডিতে
ঊর্ধ্বস্বরে চাহিব খণ্ডিতে
দিব্য বাণী।
জানি জানি
তর্কবাণ
হয়ে যাবে খান খান।
মুক্ত হবে জীর্ণ বাক্যে আচ্ছন্ন দু চোখ--
হেরিবে আলোক।

অগ্নি জ্বালো।
আজিকার যাহা ভালো
কল্য যদি হয় তাহা কালো,
যদি তাহা ভস্ম হয়
বিশ্বময়,
ভস্ম হোক।
দূর করো শোক।
মোর অগ্নিপরীক্ষায়
ধন্য হোক বিশ্বলোক অপূর্ব দীক্ষায়।

আমার দুর্বোধ বাণী
বিরুদ্ধ বুদ্ধির 'পরে মুষ্টি হানি
করিবে তাহারে উচ্চকিত,
আতঙ্কিত।
উন্মাদ আমার ছন্দ
দিবে ধন্দ
শান্তিলুব্ধ মুমুক্ষুরে,
ভিক্ষাজীর্ণ বুভুক্ষুরে।
শিরে হস্ত হেনে
একে একে নিবে মেনে
ক্রোধে ক্ষোভে ভয়ে
লোকালয়ে
অপরিচিতের জয়,
অপরিচিতের পরিচয়--
যে অপরিচিত
বৈশাখের রুদ্র ঝড়ে বসুন্ধরা করে আন্দোলিত,
হানি বজ্রমুঠি
মেঘের কার্পণ্য টুটি
সংগোপন বর্ষণসঞ্চয়
ছিন্ন ক'রে মুক্ত করে সর্বজগন্ময়॥

রবি ঠাকুরের দল সেদিন চুপ করে গেল। শাসিয়ে গেল, লিখে
জবাব দেবে।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.