Friday, July 1, 2016

শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (পর্ব-১)

শেষের কবিতা (পর্ব-১)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
অমিত রায় ব্যারিস্টার। ইংরেজি ছাঁদে রায় পদবী "রয়" ও
"রে" রূপান্তর যখন ধারণ করলে তখন তার শ্রী গেল ঘুচে
কিন্তু সংখ্যা হল বৃদ্ধি। এই কারণে, নামের অসামান্যতা
কামনা করে অমিত এমন একটি বানান বানালে যাতে ইংরেজ
বন্ধু ও বন্ধুনীদের মুখে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেল-- অমিট
রায়ে।

অমিতর বাপ ছিলেন দিগ্বিজয়ী ব্যারিস্টার। যে পরিমাণ টাকা
তিনি জমিয়ে গেছেন সেটা অধস্তন তিন পুরুষকে অধঃপাতে
দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু পৈতৃক সম্পত্তির সাংঘাতিক
সংঘাতেও অমিত বিনা বিপত্তিতে এ যাত্রা টিঁকে গেল।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ.'র কোঠায় পা দেবার
পূর্বেই অমিত অক্স্ফোর্ডে ভর্তি হয়; সেখানে পরীক্ষা
দিতে দিতে এবং না দিতে দিতে ওর সাত বছর গেল কেটে।
বুদ্ধি বেশি থাকাতে পড়াশুনো বেশি করে নি, অথচ বিদ্যেতে
কমতি আছে বলে ঠাহর হয় না। ওর বাপ ওর কাছ থেকে
অসাধারণ কিছু প্রত্যাশা করেন নি। তাঁর ইচ্ছে ছিল, তাঁর
একমাত্র ছেলের মনে অক্স্ফোর্ডের রঙ এমন পাকা করে
ধরে যাতে দেশে এসেও ধোপ সয়।

অমিতকে আমি পছন্দ করি। খাসা ছেলে। আমি নবীন লেখক,
সংখ্যায় আমার পাঠক স্বল্প, যোগ্যতায় তাদের সকলের
সেরা অমিত। আমার লেখার ঠাট-ঠমকটা ওর চোখে খুব
লেগেছে। ওর বিশ্বাস, আমাদের দেশের সাহিত্যবাজারে
যাদের নাম আছে তাদের স্টাইল নেই। জীবসৃষ্টিতে উট
জন্তুটা যেমন, এই লেখকদের রচনাও তেমনি ঘাড়ে-গর্দানে
সামনে-পিছনে পিঠে-পেটে বেখাপ, চালটা ঢিলে নড়বড়ে,
বাংলা-সাহিত্যের মতো ন্যাড়া ফ্যাকাশে মরুভূমিতেই তার
চলন। সমালোচকদের কাছে সময় থাকতে বলে রাখা ভালো,
মতটা আমার নয়।

অমিত বলে, ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী।
ওর মতে যারা সাহিত্যের ওমরাও-দলের, যারা নিজের মন
রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমলা-দলের, দশের
মন রাখা যাদের ব্যাবসা, ফ্যাশান তাদেরই। বঙ্কিমি স্টাইল
বঙ্কিমের লেখা "বিষবৃক্ষে", বঙ্কিম তাতে নিজেকে মানিয়ে
নিয়েছেন; বঙ্কিমি ফ্যাশান নসিরামের লেখা "মনোমোহনের
মোহনবাগানে", নসিরাম তাতে বঙ্কিমকে দিয়েছে মাটি করে।
বারোয়ারি তাঁবুর কানাতের নীচে ব্যাবসাদার নাচওয়ালির
দর্শন মেলে, কিন্তু শুভদৃষ্টিকালে বধূর মুখ দেখবার বেলায়
বেনারসি ওড়নার ঘোমটা চাই। কানাত হল ফ্যাশানের, আর
বেনারসি হল স্টাইলের, বিশেষের মুখ বিশেষ রঙের ছায়ায়
দেখবার জন্যে। অমিত বলে, হাটের লোকের পায়ে-চলা
রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরতে ভরসা পায় না বলেই
আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর। দক্ষযজ্ঞের গল্পে এই
কথাটির পৌরাণিক ব্যাখ্যা মেলে। ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ
একেবারে স্বর্গের ফ্যাশানদুরস্ত দেবতা, যাজ্ঞিকমহলে
তাঁদের নিমন্ত্রণও জুটত। শিবের ছিল স্টাইল, এত
ওরিজিন্যাল যে, মন্ত্রপড়া যজমানেরা তাঁকে হব্যকব্য
দেওয়াটা বেদস্তুর বলে জানত। অক্স্ফোর্ডের বি. এ.'র
মুখে এ-সব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। কেননা, আমার
বিশ্বাস, আমার লেখায় স্টাইল আছে-- সেইজন্যেই আমার
সকল বইয়েরই এক সংস্করণেই কৈবল্যপ্রাপ্তি, তারা "ন
পুনরাবর্তন্তে"।

আমার শ্যালক নবকৃষ্ণ অমিতর এ-সব কথা একেবারে সইতে
পারত না-- বলত, "রেখে দাও তোমার অক্স্ফোর্ডের
পাস।" সে ছিল ইংরেজি সাহিত্যে রোমহর্ষক এম. এ.; তাকে
পড়তে হয়েছে বিস্তর, বুঝতে হয়েছে অল্প। সেদিন সে
আমাকে বললে, "অমিত কেবলই ছোটো লেখককে বড়ো করে
বড়ো লেখককে খাটো করবার জন্যেই। অবজ্ঞার ঢাক
পিটোবার কাজে তার শখ, তোমাকে সে করেছে তার ঢাকের
কাঠি।" দুঃখের বিষয়, এই আলোচনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন
আমার স্ত্রী, স্বয়ং ওর সহোদরা। কিন্তু পরম সন্তোষের
বিষয় এই যে, আমার শ্যালকের কথা তাঁর একটুও ভালো লাগে
নি। দেখলুম, অমিতর সঙ্গেই তাঁর রুচির মিল, অথচ
পড়াশুনো বেশি করেন নি। স্ত্রীলোকের আশ্চর্য
স্বাভাবিক বুদ্ধি!

অনেক সময় আমার মনেও খটকা লাগে যখন দেখি, কত কত
নামজাদা ইংরেজ লেখকদেরকেও নগণ্য করতে অমিতর বুক
দমে না। তারা হল, যাদের বলা যেতে পারে বহুবাজারে চলতি
লেখক, বড়োবাজারের ছাপ-মারা; প্রশংসা করবার জন্যে
যাদের লেখা পড়ে দেখবার দরকারই হয় না, চোখ বুজে
গুণগান করলেই পাসমার্ক্ পাওয়া যায়। অমিতর পক্ষেও এদের
লেখা পড়ে দেখা অনাবশ্যক, চোখ বুজে নিন্দে করতে ওর
বাধে না। আসলে, যারা নামজাদা তারা ওর কাছে বড়ো বেশি
সরকারি, বর্ধমানের ওয়েটিংরুমের মতো; আর যাদেরকে ও
নিজে আবিষ্কার করেছে তাদের উপর ওর খাসদখল, যেন
স্পেশাল ট্রেনের সেলুন কামরা।

অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে
নয়, বেশে ভূষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ
আছে। পাঁচজনের মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও
হল একেবারে পঞ্চম। অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে।
দাড়িগোঁফ-কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট
মুখ, স্ফূর্তিভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া
চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না;
মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই
স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর
দলের লোক সেটা পরে না। ধুতি সাদা থানের যত্নে
কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধুতি চলতি নয়।
পাঞ্জাবি পরে, তার বাঁ কাঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের
কোমর অবধি, আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দু-
ভাগ করা; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি-দেওয়া চওড়া
খয়েরি রঙের ফিতে, তারই বাঁ দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের
এক ছোটো থলি, তার মধ্যে ওর ট্যাঁকঘড়ি; পায়ে সাদা
চামড়ার উপর লাল চামড়ার কাজ-করা কটকি জুতো। বাইরে
যখন যায় একটা পাট-করা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজি চাদর বাঁ কাঁধ
থেকে হাঁটু অবধি ঝুলতে থাকে; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রণ
থাকে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানি লক্ষ্মৌ টুপি, সাদার উপর
সাদা কাজ-করা। একে ঠিক সাজ বলব না, এ হচ্ছে ওর এক
রকমের উচ্চ হাসি। ওর বিলিতি সাজের মর্ম আমি বুঝি নে,
যারা বোঝে তারা বলে-- কিছু আলুথালু গোছের বটে, কিন্তু
ইংরেজিতে যাকে বলে ডিস্টিঙ্গুইশ্ড্। নিজেকে অপরূপ করবার
শখ ওর নেই, কিন্তু ফ্যাশানকে বিদ্রূপ করবার কৌতুক ওর
অপর্যাপ্ত। কোনোমতে বয়স মিলিয়ে যারা কুষ্ঠির প্রমাণে
যুবক তাদের দর্শন মেলে পথে ঘাটে; অমিতর দুর্লভ যুবকত্ব
নির্জলা যৌবনের জোরেই, একেবারে বেহিসেবি, উড়নচণ্ডী,
বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে, সমস্ত নিয়ে চলেছে
ভাসিয়ে, হাতে কিছুই রাখে না।

এ দিকে ওর দুই বোন, যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন
নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি-- ফ্যাশানের পসরায়
আপাদমস্তক যত্নে মোড়ক-করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট-
বিশেষ। উঁচু খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক-কাটা
জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবালে অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা
গায়ে তির্যগ্ভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপ্টানো। এরা খুট খুট করে
দ্রুত লয়ে চলে; উচ্চৈঃস্বরে বলে; স্তরে স্তরে তোলে
সূক্ষ্মাগ্র হাসি; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে
চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি; গোলাপি রেশমের
পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুর ফুর করে সঞ্চালন করে,
এবং পুরুষবন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার
আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন
প্রকাশ করে থাকে।

আপন দলের মেয়েদের সঙ্গে অমিতর ব্যবহার দেখে তার
দলের পুরুষদের মনে ঈর্ষার উদয় হয়। নির্বিশেষ ভাবে
মেয়েদের প্রতি অমিতর ঔদাসীন্য নেই, বিশেষ ভাবে কারো
প্রতি আসক্তিও দেখা যায় না, অথচ সাধারণভাবে
কোনোখানে মধুর রসেরও অভাব ঘটে না। এক কথায় বলতে
গেলে মেয়েদের সম্বন্ধে ওর আগ্রহ নেই, উৎসাহ আছে।
অমিত পার্টিতেও যায়, তাসও খেলে, ইচ্ছে করেই বাজিতে
হারে, যে রমণীর গলা বেসুরো তাকে দ্বিতীয়বার গাইতে
পীড়াপীড়ি করে, কাউকে বদ-রঙের কাপড় পরতে দেখলে
জিজ্ঞাসা করে কাপড়টা কো্ন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
যে-কোনো আলাপিতার সঙ্গেই কথা ব'লে বিশেষ
পক্ষপাতের সুর লাগায়; অথচ সবাই জানে, ওর পক্ষপাতটা
সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। যে মানুষ অনেক দেবতার পূজারি, আড়ালে
সব দেবতাকেই সে সব দেবতার চেয়ে বড়ো বলে স্তব করে;
দেবতাদের বুঝতে বাকি থাকে না, অথচ খুশিও হন। কন্যার
মাতাদের আশা কিছুতেই কমে না, কিন্তু কন্যারা বুঝে
নিয়েছে, অমিত সোনার রঙের দিগন্তরেখা, ধরা দিয়েই আছে
তবু কিছুতেই ধরা দেবে না। মেয়েদের সম্বন্ধে ওর মন তর্কই
করে, মীমাংসায় আসে না। সেইজন্যেই গম্যবিহীন আলাপের
পথে ওর এত দুঃসাহস। তাই অতি সহজেই সকলের সঙ্গে ও
ভাব করতে পারে, নিকটে দাহ্যবস্তু থাকলেও ওর তরফে
আগ্নেয়তা নিরাপদে সুরক্ষিত।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.