Friday, July 1, 2016

শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (পর্ব-২)

শেষের কবিতা (পর্ব-২)
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-
সেদিন পিকনিকে গঙ্গার ধারে যখন ও পারের ঘন কালো
পুঞ্জীভূত স্তব্ধতার উপরে চাঁদ উঠল, ওর পাশে ছিল লিলি
গাঙ্গুলি। তাকে ও মৃদুস্বরে বললে, "গঙ্গার ও পারে ঐ নতুন
চাঁদ, আর এ পারে তুমি আর আমি, এমন সমাবেশটি
অনন্তকালের মধ্যে কোনাদিনই আর হবে না।"

প্রথমটা লিলি গাঙ্গুলির মন এক মুহূর্তে ছল্ছলিয়ে উঠেছিল;
কিন্তু সে জানত, এ কথাটায় যতখানি সত্য সে কেবল ঐ
বলার কায়দাটুকুর মধ্যেই। তার বেশি দাবি করতে গেলে
বুদ্বুদের উপরকার বর্ণচ্ছটাকে দাবি করা হয়। তাই নিজেকে
ক্ষণকালের ঘোর-লাগা থেকে ঠেলা দিয়ে লিলি হেসে উঠল,
বললে, "অমিট, তুমি যা বললে সেটা এত বেশি সত্য যে, না
বললেও চলত। এইমাত্র যে ব্যাঙটা টপ করে জলে লাফিয়ে
পড়ল এটাও তো অনন্তকালের মধ্যে আর কোনোদিন ঘটবে
না।"

অমিত হেসে উঠে বললে, "তফাত আছে, লিলি, একেবারে
অসীম তফাত। আজকের সন্ধ্যাবেলায় ঐ ব্যাঙের লাফানোটা
একটা খাপছাড়া ছেঁড়া জিনিস। কিন্তু তোমাতে আমাতে
চাঁদেতে, গঙ্গার ধারায়, আকাশের তারায়, একটা সম্পূর্ণ
ঐকতানিক সৃষ্টি-- বেটোফেনের চন্দ্রালোক-গীতিকা।
আমার মনে হয় যেন বিশ্বকর্মার কারখানায় একটা পাগলা
স্বর্গীয় স্যাকরা আছে; সে যেমনি একটি নিখুঁত সুগোল
সোনার চক্রে নীলার সঙ্গে হীরে এবং হীরের সঙ্গে পান্না
লাগিয়ে এক প্রহরের আঙটি সম্পূর্ণ করলে অমনি দিলে সেটা
সমুদ্রের জলে ফেলে, আর তাকে খুঁজে পাবে না কেউ।"

"ভালোই হল, তোমার ভাবনা রইল না, অমিট,
বিশ্বকর্মার স্যাকরার বিল তোমাকে শুধতে হবে না।"

"কিন্তু লিলি, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে
আমাতে মঙ্গলগ্রহের লাল অরণ্যের ছায়ায় তার কোনো-
একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেখা হয়, আর
যদি শকুন্তলার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে
আজকের এই অপরূপ সোনার মুহূর্তটিকে আমাদের সামনে
এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করব, তার পরে কী
হবে ভেবে দেখো।"

লিলি অমিতকে পাখার বাড়ি তাড়না করে বললে, "তার পরে
সোনার মুহূর্তটি অন্যমনে খসে পড়বে সমুদ্রের জলে। আর
তাকে পাওয়া যাবে না। পাগলা স্যাকরার গড়া এমন তোমার
কত মুহূর্ত খসে পড়ে গেছে, ভুলে গেছ বলে তার হিসেব
নেই।"

এই বলে লিলি তাড়াতাড়ি উঠে তার সখীদের সঙ্গে গিয়ে
যোগ দিলে। অনেক ঘটনার মধ্যে এই একটা ঘটনার নমুনা
দেওয়া গেল।

অমিতর বোন সিসি-লিসিরা ওকে বলে, "অমি, তুমি বিয়ে কর
না কেন?"

অমিত বলে, "বিয়ে ব্যাপারটায় সকলের চেয়ে জরুরি হচ্ছে
পাত্রী, তার নীচেই পাত্র।"

সিসি বলে, "অবাক করলে, মেয়ে এত আছে।"

অমিত বলে, "মেয়ে বিয়ে করত সেই পুরাকালে, লক্ষণ
মিলিয়ে। আমি চাই পাত্রী আপন পরিচয়েই যার পরিচয়,
জগতে যে অদ্বিতীয়।"

সিসি বলে, "তোমার ঘরে এলেই তুমি হবে প্রথম, সে হবে
দ্বিতীয়, তোমার পরিচয়েই হবে তার পরিচয়।"

অমিত বলে, "আমি মনে মনে যে মেয়ের ব্যর্থ প্রত্যাশায়
ঘটকালি করি সে গরঠিকানা মেয়ে। প্রায়ই সে ঘর পর্যন্ত
এসে পৌঁছয় না। সে আকাশ থেকে পড়ন্ত তারা, হৃদয়ের
বায়ুমণ্ডল ছুঁতে-না-ছুঁতেই জ্বলে ওঠে, বাতাসে যায় মিলিয়ে,
বাস্তুঘরের মাটি পর্যন্ত আসা ঘটেই ওঠে না।"

সিসি বলে, "অর্থাৎ, সে তোমার বোনেদের মতো একটুও
না।"

অমিত বলে, "অর্থাৎ, সে ঘরে এসে কেবল ঘরের লোকেরই
সংখ্যা বৃদ্ধি করে না।"

লিসি বলে, "আচ্ছা ভাই সিসি, বিমি বোস তো অমির
জন্যে পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে, ইশারা করলেই ছুটে এসে পড়ে,
তাকে ওর পছন্দ নয় কেন? বলে,তার কালচার নেই। কেন ভাই,
সে তো এম. এ.-তে বটানিতে ফার্স্ট্। বিদ্যেকেই তো বলে
কালচার।"

অমিত বলে, "কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর
থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের
ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।"

লিসি রেগে উঠে বলে, "ইস, বিমি বোসের আদর নেই ওঁর
কাছে! উনি নিজেই নাকি তার যোগ্য! অমি যদি বিমি
বোসকে বিয়ে করতে পাগল হয়েও ওঠে আমি তাকে সাবধান
করে দেব, সে যেন ওর দিকে ফিরেও না তাকায়।"

অমিত বললে, "পাগল না হলে বিমি বোসকে বিয়ে করতে
চাইবই বা কেন? সে সময়ে আমার বিয়ের কথা না ভেবে
উপযুক্ত চিকিৎসার কথা ভেবো।"

আত্মীয়স্বজন অমিতর বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছে। তারা
ঠিক করেছে, বিয়ের দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা ওর নেই, তাই
ও কেবল অসম্ভবের স্বপ্ন দেখে আর উলটো কথা বলে
মানুষকে চমক লাগিয়ে বেড়ায়। ওর মনটা আলেয়ার আলো,
মাঠে বাটে ধাঁধা লাগাতেই আছে, ঘরের মধ্যে তাকে ধরে
আনবার জো নেই।

ইতিমধ্যে অমিত যেখানে-সেখানে হো হো করে বেড়াচ্ছে--
ফিরপোর দোকানে যাকে-তাকে চা খাওয়াচ্ছে, যখন-তখন
মোটরে চড়িয়ে বন্ধুদের অনাবশ্যক ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে;
এখান-ওখান থেকে যা-তা কিনছে আর একে-ওকে বিলিয়ে
দিচ্ছে, ইংরেজি বই সদ্য কিনে এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে ফেলে
আসছে, আর ফিরিয়ে আনছে না।

ওর বোনেরা ওর যে অভ্যাসটা নিয়ে ভারি বিরক্ত সে হচ্ছে
ওর উলটো কথা বলা। সজ্জনসভায় যা-কিছু সর্বজনের
অনুমোদিত ও তার বিপরীত কিছু-একটা বলে বসবেই।

একদা কোন্-একজন রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ডিমোক্রাসির গুণ
বর্ণনা করছিল; ও বলে উঠল, "বিষ্ণু যখন সতীর মৃতদেহ
খণ্ড খণ্ড করলেন তখন দেশ জুড়ে যেখানে-সেখানে তাঁর
একশোর অধিক পীঠস্থান তৈরি হয়ে গেল। ডিমোক্রাসি
আজ যেখানে-সেখানে যত টুকরো অ্যারিস্টক্রেসির পুজো
বসিয়েছে; খুদে খুদে অ্যারিস্টক্রাটে পৃথিবী ছেয়ে গেল-- কেউ
পলিটিক্সে, কেউ সাহিত্যে, কেউ সমাজে। তাদের কারো
গাম্ভীর্য নেই, কেননা তাদের নিজের 'পরে বিশ্বাস নেই।"
একদা মেয়েদের 'পরে পুরুষের আধিপত্যের অত্যাচার নিয়ে
কোনো সমাজহিতৈষী অবলাবান্ধব নিন্দা করছিল পুরুষদের।
অমিত মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে ফস করে বললে, "পুরুষ
আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের
আধিপত্য অতি ভয়ংকর।"

সভাস্থ অবলা ও অবলাবান্ধবেরা চটে উঠে বললে, "মানে কী
হল।"

অমিত বললে, "যে পক্ষের দখলে শিকল আছে সে শিকল
দিয়েই পাখিকে বাঁধে, অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার
সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা
বাঁধে বটে, কিন্তু ভোলায় না; আফিমওয়ালী বাঁধেও বটে,
ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-
শয়তানী তার জোগান দেয়।"

একদিন ওদের বালিগঞ্জের এক সাহিত্যসভায় রবি ঠাকুরের
কবিতা ছিল আলোচনার বিষয়। অমিতর জীবনে এই সে
প্রথম সভাপতি হতে রাজি হয়েছিল; গিয়েছিল মনে মনে
যুদ্ধসাজ প'রে। একজন সেকেলেগোছের অতি ভালোমানুষ
ছিল বক্তা। রবি ঠাকুরের কবিতা যে কবিতাই এইটে প্রমাণ
করাই তার উদ্দেশ্য। দুই-একজন কলেজের অধ্যাপক ছাড়া
অধিকাংশ সভ্যই স্বীকার করলে, প্রমাণটা একরকম
সন্তোষজনক।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.